Editorial

হিমন্তের পুশব্যাক

সম্পাদকীয় বিভাগ

আগ্রাসী হিন্দুত্বের পোস্টারবয় হবার জন্য আদা জল খেয়ে নেমেছেন আসামের বিজেপি’র মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। আসামে বি‍‌জেপি’র অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং নিজের পারিবারিক দুর্নীতি থেকে বেরিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর গদি রক্ষার জন্য মোদী-শাহ’র কাছে নম্বর বাড়ানো ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। তাছাড়া জনমানসে সরকারের কার্যকলাপ যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে তার থেকে সরকারকে আবার জিতিয়ে আনা কম মাথা ব্যথার বিষয় নয়। সব মিলিয়ে ভয়ানক চাপে আছেন বিশ্বশর্মা। এই অবস্থা উগ্র ও আগ্রাসী হিন্দুত্বের পথে তীব্র মুসলিম বিদ্বেষকেই তিনি রাজনীতির প্রধান অস্ত্র হিসাবে কাজে লাগাতে চাইছে।
আসামের রাজনীতিতে উগ্র হিন্দত্ববাদকে প্রধান অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে হলে অন্যান্য রাজ্যের মতো মুসলিম বিদ্বেষকেই  অবলম্বন করতে হয়। আর এই মুসলিম বিদ্বেষ দানা বাঁধে প্রধানত অনুপ্রবেশকে ইস্যু করে। তাই আসামে বিশ্বশর্মা তাঁর এবং দলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখার জন্য অনুপ্রবেশকেই আঁকড়ে ধরেছেন। মুখ্যমন্ত্রী হবার পর থেকেই তিনি বাংলাভাষী‍‌, বিশেষ করে বাংলাভাষী মুসলিমদেরই  আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য বস্তু করেছেন। ক্রমাগত প্রচার এবং সরকারি পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি এটা জনমানসে  প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন বাংলাভাষী  মাত্রই বাংলাদেশের নাগরিক। তার ধর্মে মুসলিম হলে তো কথাই নেই। যুক্তি, তর্ক, তথ্য প্রমাণাদি নিয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের কোনও মাথাব্যথা নেই।  যখন ভেবে নিয়েছে  মুসলিম মানেই বাংলাদেশের লোক, অতএব তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে দেশ থেকে তাড়াতে হবে। এমন অবস্থায় থেকেই  উত্তর প্রদেশের যোগীর অনুসরণে বিশ্বশর্মার  বুলডোজার বিচার প্রকল্পের  যাত্রা শুরু। গত কয়েক বছরে কয়েক ডজন বার আগাম ঘোষণা ছাড়া আচমকা বুলডোজার হামলা চালিয়ে অসংখ্য গরিব মুসলিম পরিবারের ঘরবাড়ি  ভেঙে দিয়ে তাদের নিঃস্ব করা হয়েছে। আস্তানা কেড়ে নিয়ে উদ্বাস্তু করেছে। অভিযোগ তারা নাকি সরকারি জমিতে যে বেআইনিভাবে বসবাস করছে। আবার একই অভিযোগে তাদের দোকানপাট, ছোটখাট  ব্যবসাও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারের দেখে মনে হতে পারে, একমাত্র মুসলিমরা অবৈধভাবে সরকারি জমিতে বাস করে। অবশ্য বাংলাভাষী হিন্দুরাও এমন আক্রোশ থেকে ছাড় পায় না। কিছুদিন নাবালিকা বিয়ে করেছে  এই অভি‍‌যোগে  রাতবিরেতে বাড়িতে বাড়িতে হামলা চালিয়ে পু‍লিশ মুসলিম যুবকদের তুলে নিয়ে জেলে  পুরতে শুরু করে। অর্থাৎ কোনও না কোনও অজুহাতে মুস‍‌লিমদের বিরুদ্ধে অতি সক্রিয়তাই বিশ্বশর্মার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
সম্প্রতি মুসলিমদের ধরে ধরে বিদেশি তকমা দিয়ে জোর করে সীমান্তের ওপারে পাঠানো চলছে। এটা ‘পুশব্যাক’ নামে পরিচিত। ফরেনার্স ট্রাইবুনালে বিদেশি ঘোষিত ৩৩০ জনকে গত কয়েক সপ্তাহে পুশব্যাক করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে আছে শিশু, মহিলা এমনকি ৩০ বছর শিক্ষকতায় যুক্ত সরকারি স্কুলের শিক্ষকও। অনেকের বিষয়টি হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্টে বিচারাধীন। এতদসত্ত্বেও অত্যুৎসাহে তাদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিচ্ছেন হিমন্ত। এখন ১৯৫০ সালের পরিত্যক্ত একটি আইনকে কাজে লাগিয়ে পাইকারিহারে মুসলিমদের পুশব্যাক করার অভিযানে নামতে চাইছেন। এতে ‍ জেলাশাসক আপাতদৃষ্টিতে কাউকে বিদেশি মনে হলেই তাকে তাড়িয়ে দিতে পারবেন।
এই পুশব্যাককে কেন্দ্র করে সীমান্তে নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে তিক্ততা বাড়ছে। এদিক থেকে পুশব্যাক হলেও  ওদিকে বাংলাদেশ গ্রহণ করছে না। ফলে দু’দেশের সীমান্তের মাঝে নো ম্যা নস ল্যা ন্ডে নারী-শিশু-বৃদ্ধরা খোলা আকা‍‌শের নিচে থাক‍‌তে বাধ্য হচ্ছেন। এমন  চরম অমানবিক পথে মোদী-শাহ’র মদতে হাঁটছেন বিশ্বশর্মা। সত্যিকারের বিদেশি অনুপ্রবেশকারীকে পুশব্যাকের অধিকার অবশ্যই আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিধি ব্যবস্থায় সেখানেও কূটনীতি থাকে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সদ্ভাবের স্বার্থে তাদের সঙ্গে কথা বলেই পুশব্যাক করা সঙ্গত। কিন্তু দাদাগিরির মনোভাব থাকে হিমন্তরা সেসব তোয়াক্কা করছেন না। এতে বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন সংঘাতের জমি তৈরি হবার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।

Comments :0

Login to leave a comment