Editorial

‘পুশব্যাক’র নামে অত্যাচার

সম্পাদকীয় বিভাগ

বাংলাদেশি বিতাড়নের নামে সম্প্রতি মহারাষ্ট্র থেকে বাংলাভাষীদের চিহ্নিত করে জোর করে বাংলাদেশে পাঠানোর ঘটনা শুধু নিন্দনীয় নয়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এভাবে প্রশাসনের মস্তানসুলভ ব্যবহারের প্রতিবাদেরও প্রয়োজন আছে। নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের পাশাপাশি মানবাধিকারের ওপরেও এটা আঘাত। মুর্শিদাবাদের চারজন এবং পূর্ব বর্ধমানের একজন, যারা এরাজ্যে কাজের সুযোগ না পেয়ে মহারাষ্ট্রে গিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করছিলেন, মুম্বাই পুলিশ শুধুমাত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও  ‘বাংলাভাষী’ বলে তাঁদের বাংলাদেশি নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত করে এবং তারপর বিএসএফ’র হাতে তুলে দেয়। পুলিশের পরে বিএসএফ’র হাতে তাঁদের হেনস্তার শিকার হতে হয় এবং তারপর বিএসএফ কোচবিহার জেলার বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে তাঁদের বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ঠেলে পাঠায়। কোনও স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে কাউকে জোর করে দেশ থেকে তাড়ানো যায়? নাগরিকত্ব বিচার করেছে কে? পুলিশ আর বিএসএফ? তাহলে এদেশে আইন-আদালতের প্রয়োজন কি ফুরিয়ে গেছে? 
বিষয়টির গুরুতর তাৎপর্য রয়েছে। কারণ মুম্বাই পুলিশ এবং বিএসএফ যে গায়ের জোরে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা ভারতীয় নাগরিকদেরই জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল তা এখন প্রমাণিত। মুর্শিদাবাদের যে নাগরিকদের জোর করে কোচবিহারের সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল তাঁদের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগের ভিত্তিতে এরাজ্যের পুলিশ নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়। মুর্শিদাবাদের ঐ বাসিন্দারা যে ভারতীয় নাগরিক, তাঁদের যে বৈধ সব কাগজপত্রই আছে, তা প্রমাণিত হওয়ার পরেই মুর্শিদাবাদ পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের ভিত্তিতে বিএসএফ ঐ চারজনকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। অর্থাৎ মুম্বাইতে কর্মরত পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দারা ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ দেওয়া সত্ত্বেও মুম্বাই পুলিশ এবং বিএসএফ তাঁদের জবরদস্তি বাংলাদেশি বলে ‘পুশব্যাক’ করেছিল। মুর্শিদাবাদের পরিযায়ী শ্রমিকরা পরিবারের সদস্যদের ফোনে একথাও জানিয়েছেন যে আধার কার্ড, ভোটার কার্ড সব দেখানো সত্ত্বেও তাঁদের ওপরে জবরদস্তি হয়েছে। সোজা কথায়, বাংলা ভাষা এবং মুসলিম ধর্ম পরিচয় দেখেই মুম্বাইয়ের পুলিশ এবং বিএসএফ বাংলাদেশি নির্ধারণ করে ফেলেছিল। এরপরে এদেশের বুকে আইন-আদালত বিচার প্রক্রিয়ার আর কোনও অবকাশ রয়েছে কিনা প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। দেশজুড়ে বিজেপি এবং আরএসএস যে কথা প্রচার করছে, বাংলাভাষী, মাছ খাওয়া, ধর্মপরিচয় এগুলির সঙ্গে তারা বাংলাদেশি পরিচয়কে জুড়ে দিচ্ছে। তার সঙ্গে ঘৃণা ও বিদ্বেষের প্রচারও করছে। এই ‘অনুপ্রবেশকারী’দের দেশের পক্ষে বিপজ্জনক, সন্ত্রাসবাদী বলে দেখানো হচ্ছে। এর আগে গুজরাট থেকেও এভাবে বাংলাদেশি নামে বাঙালিদের আগরতলা দিয়ে বিতাড়ন করা হয়েছিল। এবার কোচবিহার সীমান্ত দিয়ে সেই চেষ্টা করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের মানুষ থাকেন, বাংলার মানুষও দেশের বিভিন্ন রাজ্যে রয়েছেন। ভারতের সংবিধান অনুসারে দেশের যে কোনও রাজ্যের মানুষ যে কোনও রাজ্যে যেতে পারেন, থাকতে পারেন। সংবিধানের সেই নির্দেশকে অমান্য করে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ওপরেই আঘাত হানা হচ্ছে বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলির প্রশাসন এবং বিএসএফ’কে ব্যবহার করে। 
প্রশ্ন ওঠে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমিকা নিয়েও। মুখ্যমন্ত্রী কি কেবল রাজনীতির বাজারেই বাংলা ও বাঙালিদের নিয়ে হইচই করে বেড়াবেন? তাঁর কোনও প্রশাসনিক দায়িত্ব নেই? একে তো গ্রামবাংলায় কাজের হাহাকার, এরাজ্যে কাজ না পেয়ে বাধ্য হয়েই যুবকরা ভিনরাজ্যে কাজের জন্য চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। এরপরে তাঁরা ভিনরাজ্যে আক্রান্ত হলে কেন তৃণমূল সরকারের প্রশাসন চুপ করে বসে আছে? কেন এরাজ্যের প্রশাসনের পক্ষ থেকে মহারাষ্ট্র ও গুজরাট সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে আইনমাফিক পদক্ষেপের দাবি জানানো হচ্ছে না? বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যখন বিরোধী দলনেত্রী ছিলেন তখন তিনিও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ নিয়ে রাজনীতি করেছিলেন। তাঁর রাজনীতির সঙ্গে বিজেপি’র মূলগত রাজনৈতিক বিরোধ নেই বলেই কি তিনি চুপ করে রয়েছেন?

Comments :0

Login to leave a comment