CLIMATE CHANGE IMPACT ON FISHERMEN

জলবায়ু পরিবর্তনের জের, জীবিকা হারাচ্ছেন ক্ষুদ্র মৎসজীবীরা

জাতীয়

small fishermen climate change global warming cyclones cyclonic storms bengali news

ভয়ঙ্কর হারে বাড়ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। তারফলে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্টের তাপমানও। এই দুইয়ের যোগফলে প্রতিবছর হানা দিচ্ছে সামুদ্রিক ঘুর্ণিঝড়। 

২০২১ সালে আরব সাগরের সামুদ্রিক ঘুর্ণিঝড়ের প্রকোপ নিয়ে ক্লাইমেট ডাইনামিক্স জার্নালের তরফে একটি গবেষণা চালানো হয়। সেই গবেষণা অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সাইক্লোনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৮০ শতাংশ। 

কেবলমাত্র সাধারণ সাইক্লোনই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে অতি শক্তিশালী সাইক্লোনের সংখ্যাও। ক্লাইমেট ডাইন্যামিক্সের গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৮২ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে অতি শক্তিশালী সামুদ্রিক ঘুর্ণিঝড়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে তিনগুণ। 

প্রকৃতির হঠাৎ এই পরিবর্তনের ফলে সবথেকে সমস্যায় পড়েছেন মালাবার উপকূলবর্তী গ্রামের বাসিন্দারা। এই অংশের মানুষ মূলত আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁরা সমুদ্রে মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। কিন্তু ক্রমাগত বেড়ে চলা সাইক্লোনের ফলে তাঁদের জীবিকার পাশাপাশি বাসস্থানও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্লাইমেট ডাইন্যামিক্সের গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আগে যেখানে দশকে একবার ভয়াল ঘুর্ণিঝড়ের দেখা মিলত, এখন সেখানে প্রতি বছর দেখা মেলে অতি শক্তিশালী সাইক্লোনের। 

গবেষণার জন্য মালাবার উপকূলের দক্ষিণ চেল্লানাম গ্রামের বাসিন্দাদের সাক্ষাৎকার নেন ক্লাইমেট ডাইনামিক্সের গবেষকরা। 

তাঁরা জানাচ্ছেন, ঝড়ের পরিমাণ বাড়ায় নিয়ম করে তাঁদের নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় সমস্ত নৌকা মেরামত করা সামর্থে কুলোচ্ছে না সমস্ত মৎসজীবী পরিবারের। ঋণ নিয়ে কেনা নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া জীবীকার সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। 

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঠিক একইরকম ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন সুন্দরবন, পূর্ব মেদিনীপুর সহ এরাজ্যের উপকূলবর্তী অঞ্চলের মৎসজীবীরাও। 

দক্ষিণ চেল্লানামের বাসিন্দা ভিএস পোডিয়াল। ২০১৯ সালে ১৮জনের একটি দলকে নিয়ে তিনি গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। মাঝ সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পড়ে দলটি। 

পোডিয়াল গবেষকদের জানিয়েছেন, ঢেউয়ের দাপটে আমার নৌকা উল্টে যায়। আমরা সবাই সমুদ্রে ভাসতে থাকি। পরবর্তীকালে সবাইকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও, পোডিয়ালের কাঠের নৌকাটি আর সারানো যায়নি। 

সেই থেকে পোডিয়ালের ‘রোসমেরি’র ঠাঁই হয়েছে চেল্লানামের নৌকার কবরখানায়। বর্তমানে নৌকাটির দখল নিয়েছে সামুদ্রিক আগাছা। 

পোডিয়াল জানাচ্ছেন, আগে এই কবরখানায় খুব কম নৌকা আসত। কিন্তু বিগত বেশ কিছু বছর ধরে এলাকার কারোর না কারোর নৌকা নিয়মিত আসছে এখানে। 

পোডিয়ালের থেকেও খারাপ অবস্থায় রয়েছেন পিভি উইলসন। ২০২১ সালে তাঁর নৌকা সমুদ্রে ডুবে যায়। নতুন নৌকা কেনার সামর্থ না থাকায় জীবিকা বদলে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন উইলসন। 

উইলসন গবেষকদের জানিয়েছেন, সমুদ্রে মাছ ধরে কিছুটা আর্থিক সমৃদ্ধির মুখ দেখেছিলেন তিনি। স্বপ্ন দেখেছিলেন দুই মেয়েকে উচ্চ শিক্ষিত করবেন। মেয়েরা শিক্ষিকা হতে চাইত। কিন্তু প্রকৃতির রোষে স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গিয়েছে। দুই মেয়েই পরিস্থিতির চাপে লেখাপড়ায় ইতি টেনেছে। 

মৎসজীবীরা জানাচ্ছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের চরিত্র পাল্টে গিয়েছে। আগে সমুদ্রকে হাতের তালুর মত চিনতেন মৎসজীবীরা। তাঁরা জানতেন ঠিক কোন সময়ে সমুদ্রের কোন জায়গার আবহাওয়া কেমন থাকবে। তারফলে একদিকে যেমন মাছের যোগান নিয়ে চিন্তা করতে হত না, তেমনই ঝড়ের আগাম সতর্কতা থাকায় ক্ষয়ক্ষতিরও সম্মুখীন হতেন না মৎসজীবীরা। 

কিন্তু বর্তমানে সবটাই বদলে গিয়েছে। খামখেয়ালী সমুদ্রকে পড়তে পারছেন না, বুঝতে পারছেন না অভিজ্ঞ মৎসজীবীরাও। 

এই পরিবর্তনের ফলে সবথেকে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছেন পোডিয়াল কিংবা উইলসনের মতো দরিদ্র মৎসজীবীরা। তাঁরা সারা জীবনের সঞ্চয় জমিয়ে নৌকা কেনেন। কিন্তু সেই নৌকা অকেজো হলে দ্বিতীয় নৌকা জোগাড়ের সামর্থ থাকে না তাঁদের। 

দক্ষিণ চেল্লানামে প্রায় ৬০০ পরিবারের বাস। এরমধ্যে ৯৯ শতাংশ পরিবার মাছ ধরেই জীবীকা নির্বাহ করেন। 

মৎসজীবীরা জানাচ্ছেন, সমুদ্রের নির্দিষ্ট অঞ্চলে নির্দিষ্ট স্রোত থাকে। কোনও স্রোত ঠান্ডা, আবার কোনোটা গরম। এই স্রোত অনুযায়ী মাছের দেখা মেলে। কিন্তু উষ্ণায়নের ফলে স্রোতের হিসেবও পাল্টে গিয়েছে। তারফলে মাছ ধরার খরচ প্রতি বছর বৃদ্ধি পেলেও মাছের পরিমাণ ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে। মাছের দল অনেক গভীর সমুদ্রে চলে গিয়েছে। সেখানে পৌঁছনোর সাধ্য নেই ক্ষুদ্র মৎসজীবীদের। 

অধিকাংশ মৎসজীবী সুদের কারবারিদের থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে থাকেন। আগে সমস্যা না হলেও বর্তমানে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছেন তাঁরা। কারণ? সহজেই অনুমান করা যায়। 

পোডিয়াল জানাচ্ছেন, আমি ১০ শতাংশ সুদের বিনিময়ে ২৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। এখন সেই পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু টাকা শোধ করার কোনও উপায় আমার কাছে নেই। 

পোডিয়ালের আশঙ্কা, খুব শীঘ্রই সুদের কারবারিদের হেনস্থার মুখে পড়তে হবে তাঁকে। 

ক্ষুদ্র মৎসজীবীদের পাশে দাঁড়াতে ইতিমধ্যেই কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে কেরালা সরকার। ২০১৮ সালে পিনারাই বিজয়ন সরকার সামুদ্রিক ঘুর্ণিঝড়ের আগাম সতর্কতা দেওয়ার জন্য একটি কেন্দ্র স্থাপন করেছে। 

এর পাশাপাশি ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তর বা আইএমডি’র তরফেও নিয়মিত ভাবে মৎসজীবীদের ঝড়ের সতর্কতা দেওয়া হয়ে থাকে। ভারতের উপকূল জুড়ে মোট ৭টি সতর্কতা কেন্দ্র রয়েছে। 

যদিও আইএমডি’র কর্তারা জানাচ্ছেন, উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্র আগের তুলনায় অনেক বেশি অশান্ত হয়ে উঠেছে। তারফলে ঢেউয়ের উচ্চতা বেড়েছে। সেই ঢেউয়ের চাপেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় কাঠের তৈরি ছোট নৌকা। এর পাশাপাশি বাজ পড়ার ফলেও ক্ষতি হয় এই নৌকাগুলির। 

আইএমডি চেষ্টা করছে শক্তিশালী ঘুর্ণিঝড়ের পাশাপাশি কম তীব্রতার বজ্রবিদ্যুৎ সহ ঝড়ের আগাম সতর্কতাও মৎসজীবীদের কাছে পৌঁছে দিতে। 

কিন্তু সেই কাজ কবে শেষ হবে কেউ জানে না। 

Comments :0

Login to leave a comment