North-Bengal

উত্তরবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর দ্বিচারিতার নমুনা

উত্তর সম্পাদকীয়​

জীবেশ সরকার
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গ সফরে এসেছিলেন তা সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্ব দিয়েই প্রচারিত হয়েছে। তিনি শিলিগুড়িতে উত্তরবঙ্গের ব্যবসায়ী‍‌দের নিয়ে সভা করলেন, সাথে রাখলেন তাঁর দলের নেতাদের। শিলিগুড়ির অদূরে ফুলবাড়িতে সরকারি প্রকল্পের বিষয়ক সভা করে কার্যত দলীয় সভা করলেন। উত্তরকন্যায় প্রশাসনিক সভা করলেন, যার বিবরণ সংবাদ মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারিত হলো। মুখ্যমন্ত্রীর এই কর্মসূচি নিয়ে প্রচার হলো অনেক। বিমানবন্দর থেকে মুখ্যমন্ত্রীর যাত্রাপথ পুরোটাই লক্ষ লক্ষ সরকারি অর্থ ব্যয় (অপচয়) করে তার নানা ভঙ্গিমার ছবি দিয়ে, পতাকা দিয়ে সাজানো হলো। দীর্ঘ সময় অনেক রাস্তা আটকে রেখে জনসাধারণের দুর্গতি  বৃদ্ধি করা হলো  মুখ্যমন্ত্রীর যাত্রাপথ মসৃণ করার জন্য। আয়োজন তো হলো বিপুল, কিন্তু উত্তরবঙ্গবাসী  কি পেল? আদৌ কিছু বিভ্রান্তিকর চটকদারি কথা, বিকৃত তথ্য, নিজের সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি আড়াল করার জন্য নানা অসত্য কথা, সত্যের অপলাপ ছাড়া উত্তরবঙ্গবাসীর বরাতে প্রতিবারের মতো এবারও কিছুই জুটল না। অবশ্য এতে নতুন কিছু নেই। কয়েক মাস পরেই রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন। তাই উনি  এসেছেন, আবারও  আসবেন। উত্তরবঙ্গবাসীকে বোকা বানানোর চেষ্টা করবেন। কিন্তু বেশি মানুষকে তো বেশিদিন বোকা বানিয়ে রাখা যায় না। 
মুখ্যমন্ত্রীর সফরকালে তাঁর মুখ থেকে উত্তরবঙ্গের জনগণ বিশেষ করে  যুবসমাজ শুনতে চেয়েছিল যে শিক্ষাক্ষেত্রে  রাজ্যে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির ফলে ও আদালতের রায়ে যে শিক্ষকরা  কাজ হারালেন এবং শাসকদলের ও সরকারের মাধ্যমে  টাকার বিমিনয়ে যে অ‍‍‌যোগ্যরা ‍‌শিক্ষকতার চাকরি কিনেছিল তাদের  রক্ষা করার জন্য যে যোগ্য শিক্ষকরা কাজ হারিয়ে আজ রাস্তায় ধরনা দিচ্ছে, পুলিশের হামলায় নির্যাতিত হচ্ছে তারা কেন সরকারের দুর্নীতির দায় বহন করবে? এই যোগ্য  শিক্ষকদের একটি অংশ উত্তরবঙ্গের। সারা রাজ্যের মতো উত্তরবঙ্গেও একের পর এক সরকারি স্কুল ‍‌শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীর অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রমরমা বেসরকারি স্কুলের। এদের পৃষ্ঠপোষক রাজ্য সরকার বা শাসকদল। মুখ্যমন্ত্রী অনেক কথা বললেন,  কিন্তু এ ব্যাপারে কোনও সদুত্তর নেই।
মুখ্যমন্ত্রী প্রতি বছর ঢাকঢোল পিটিয়ে শিল্প সম্মেলন করেন। সেখানে অনেক ভাষণ হয়, চমকপ্রদ কথা হয়, ‘মৌ’ (!) স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু বিনিয়োগ আসে না। শিলিগুড়িতে উত্তরবঙ্গের ব্যবসায়ীদের নিয়ে তারই একটি ছোট নাটকীয় সংস্করণ করলেন।  কোনও  শিল্প সম্ভাবনা দূর অস্ত— ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করলেন তারা কিভাবে সিন্ডিকেট, তোলবাজি ও সরকারি অসহযোগিতার ‍ শিকার হচ্ছেন। আশ্চর্যের বিষয় মুখ্যমন্ত্রী বললেন তিনি নাকি এসব জানেন না।  মিথ্যাচারের এই নমুনা তো নতুন নয়। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন যে তিনি নাকি উত্তরবঙ্গে আরও পাঁচটি শিল্প কেন্দ্র গড়ে তুলবেন। মিথ্যা প্রতিশ্রুতির আরেকটি নমুনা মাত্র।
বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে গড়ে ওঠা উত্তরবঙ্গের শিল্প প্রকল্পগুলি তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের আমলে হয় বন্ধ হয়ে গেছে,  না হ‍‌লে  ধুঁকছে। এই সর্বনাশা চিত্র অস্বাভা‍‌বিক নয়। কেন না, শিল্প তাড়িয়েই তো উনি মুখ্যমন্ত্রীর গদি দখল করেছেন। তাই প্রশ্ন উঠেছে, শিলিগুড়িতে নির্মিত ‘ড্রাই পোর্ট’, ‘টী পার্ক’, ভিডিওকন শিল্প, জলপাইগুড়ি ফল প্রক্রিয়াকরণ, কোচবিহারের চকচকার শিল্প কেন্দ্র আজ এই দুরবস্থায় কেন? জবাব নেই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। মানুষ তো জবাব  চাইছে— যতদিন যাচ্ছে ততোই উত্তরবঙ্গের যে মানুষরা সরলভাবে বিশ্বাস করেছিল যে এই সরকার হয়তো বা শিল্পস্থাপন বা কর্মসংস্থানমুখী কিছু করবে। কিন্তু আজ  তাদের বড় অংশই হতাশ। এই সরকারের আমলে সারা রাজ্যের মতো উত্তরবঙ্গেও  উৎপাদনশীল কোনও শিল্প, কোনও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী শিল্প গড়ে তোলা হয়নি। বেকার যুবকদের সিন্ডিকেটের ও তোলাবাজ বাহিনীতে যুক্ত করার প্রকল্প পরিণত করা হয়েছে স্থানীয় পঞ্চায়েত ও পৌরসভাগুলিকে। সঙ্গে মদত ‍‌দিচ্ছে পু‍‌লিশ প্রশাসন।
মুখ্যমন্ত্রী সব জানেন, কিন্তু তিনি সভায় বললেন যে তিনি নাকি এসব বরদাস্ত করবেন না! বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, ‘‘সাপ হয়ে দংশাও’ ওঝা হয়ে ঝাড়ো।’’ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষেত্রে এই প্রবাদ একশত ভাগ সত্য। তাঁর মত ছাড়া রাজ্যের সরকার বা তৃণমূল কংগ্রেস দলের গাছে কোনও পাতা নড়ে না। আর তিনি জনগণের কাছে সাধু সাজার জন্য এই ধরনের অসত্য বক্তব্য রাখলে মানুষ কি আর বিশ্বাস করবে? 
মুখ্যমন্ত্রী এবারেও তার উত্তরবঙ্গ সফরে চিরাচরিত ভঙ্গিতে চা বাগান শ্রমিকদের সাথে ছবি তুললেন। সংবাদ মাধ্যমে তা প্রচারেও ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু তার সফরকালেই  বন্ধ  হয়ে গেল আরেকটি চা বাগান — কর্মহীন হলো ‘মধু চা বাগান’-এর কয়েক শত শ্রমিক। তার সরকারের সিদ্ধান্ত চা বাগানের জমি দেওয়া হবে বড় বড় ব্যবসায়ীদের, তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে। অথচ শ্রমিকদের বাস্তু জমি  বা আবাসের প্রশ্নটির কোনও সুরাহা নেই। তার এই সফরকালেই শিলিগুড়ির সন্নিকটে দাগপুর চা বাগানের শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছে  কেন না তাদের চা বাগানের জমির বড় অংশ পাঁচ তারা হোটেল করার জন্য দেওয়া হয়েছে একটি বেসরকারি সংস্থাকে। চা বাগান শ্রমিকরা দীর্ঘ দিন ধরে যে ন্যূনতম মজুরির দাবিতে  আন্দোলন করছে তা নিয়ে তিনি একটি কথাও এবারের সফরেও বললেন না। মুখ্যমন্ত্রীর আচরণের দ্বিচারিতা এভাবেই স্পষ্ট হয়।
নানা জাতি-জনজাতি-জনগোষ্ঠীর সমাহারে বৈচিত্রপূর্ণ উত্তরবঙ্গ। বৈচিত্রের মধ্যে ‍ ঐক্যই উত্তরবঙ্গের অনন্য বৈশিষ্ট্য। আবার এই ঐক্যকে বিনষ্ট করার জন্য নানা বিভাজনের শক্তিও এখানে তৎপর। নিজেদের ক্ষমতা লাভ ও দখলদারির জন্য তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি নানাভাবে এই বিভাজনের শক্তিগুলিকে মদত দেয় ও সহযোগী করে। এক্ষেত্রে এই দুই দলের মধ্যে চলে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা। ধর্ম ও রাজনীতির মিশেলে এই পারস্পরিক প্রতিযোগিতা নির্বাচনী সংগ্রামে ‘‘বাইনারি’ তৈরি করে। এই ‘‘বাইনারি’’তে বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস উভয়েই লাভবান হয়। মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরবঙ্গ সফর এই বিভাজনের শক্তিগুলিকে উৎসাহিত করে। এবারেও মুখ্যমন্ত্রীর কর্মসূচিতে এই লক্ষ্যকেও তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। কেন না, সামনেই বিধানসভা নির্বাচন! মুখে বি‍‌জেপি বিরোধিতা থাকলেও তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি উভয়েই আরএসএস’র প্রকল্পই উত্তরবঙ্গে কার্যকর করে চলেছে।
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা কার্যত ভেঙে প‍‌ড়েছে। পু‍‌লিশ-প্রশাসন শাসকের  ‘দলদাস’’-এ পরিণত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রকাশ্যসভা বা প্রশাসনিক সভায় মুখ্যমন্ত্রীর শাসনে যখন  পু‍‌লিশ-প্রশাসনের অনৈতিক কাজ, দুর্নীতি ও বেআইনি কাজের অভিযোগ উ‍‌ঠেছে তখন তিনি নিজেকে স্বচ্ছ প্রমাণ করার জন্য  ও তাঁর ঘনিষ্টদের আড়াল করার বিষয়টি না জানার ‘‘ভান’’ করেন। কখনও আবার পু‍‌লিশকর্তা বা কোনও মন্ত্রীকে ধমক দেওয়ার অভিনয় করেন। এবারও তি‍‌নি তাই ক‍‌রেছেন প্রতিটি সভায়। কিন্তু এবার একটি চমকপ্রদ ঘটনা সামনে এসেছে। প্রকাশ্য সভায় ‍ কোচবিহার জেলার এসপি’কে ধমক দিয়ে নির্দেশ দিয়েছেন যে তাঁর (মুখ্যমন্ত্রীর) ঘনিষ্ট একজন পুলিশ আধিকারিককে কেন আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেওয়া হচ্ছে না! বালি মাফিয়াদের ট্রাকগুলি পু‍‌লিশের সামনে দিয়ে চলাচল করার অভিযোগ উঠলেই তিনি ধমকের সুরে রাজ্যপুলিশের ডিজিকে ব্যবস্থা নিতে বলে নিজের দায় এড়ানোর চেষ্টা করেন। আসলে তিনি জানেন উত্তরবঙ্গের এই বালি মাফিয়া বা সিন্ডিকেটের মাথা হলো তাঁর দলেরই  গুরুত্বপূর্ণ নানা নেতা। আসলে স্বৈরাচারী শাসকরা বরাবরই নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য এমনকি আপন সঙ্গীদেরও অপমান করতে  দ্বিধা করে না। মুখ্যমন্ত্রীর এবারের উত্তরবঙ্গ সফরে নানা ঘটনাক্রমে এই বাস্তব সত্যটি প্রকট হলো।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়  এবারেও উত্তরবঙ্গে এলেন, কোটি টাকা  ব্যয় করে সাজানো হলো যাত্রাপথ ও মঞ্চগুলি, তিনি অবিরাম অসত্য ভাষণে সংবাদ মাধ্যমের পাতা ভরালেন, কিন্তু উত্তরবঙ্গের মানুষের যে আস্থা তিনি হারিয়েছেন তা দূর করতে ব্যর্থই হলেন। কেন না মানুষ তৃণমূল কংগ্রেসের ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের অপশাসন থেকে মুক্তি অর্জনের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

Comments :0

Login to leave a comment