পরিতোষ সরকার
কয়েকদিন আগে খবরের কাগজে এক মর্মান্তিক ভয়ানক খবর আমাদের বোধবুদ্ধি, চেতনার ভিতকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল। হয়তো এই খবরটি জেনে এ রাজ্যের অনেকেরই আমার মতই মানসিক প্রতিক্রিয়া ঘটে থাকবে। নিশ্চয়ই এ রাজ্যের সব মানুষের বিবেক চেতনার ঘর অর্গলবন্ধ নয়।
এ রাজ্যেরই এক কিশোর ও তার প্রমাণ দিয়ে গেল আমাদের শাসনে। তার মনের ভেতরে বিবেকবোধ আত্মসম্মান, মান, আপমানবোধ কতটা জাগ্রত— চুরির অপবাদ অপমান তার মনকেও কতটা নাড়িয়ে দিয়েছিল— যার জন্য এই কিশোর বয়সেও আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে চুরির মিথ্যে কলঙ্কের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ধিক্কার জানিয়ে গেল এই সপ্তম শ্রেণির কিশোরটি।
মেদিনীপুরের তমলুকের এই কিশোর আত্মহত্যার আগে মা-কে চিঠি লিখে দীপ্ত কণ্ঠে জানিয়ে যায়— ‘‘মা আমি কুড়কুড়াটি (কুড়কুড়ে এক ধরনের চিপস্) রাস্তার ধারে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম; ‘চুরি’ করিনি।’’
কিন্তু এই কিশোর ছেলেটি পথের বাজারের লোকদের এ কথাটা বিশ্বাস করাতে পারেনি। বরং এক সিভিক ভলান্টিয়ার ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা মিলে ভিড়ের বাজারে ছেলেটিকে কেবল ‘চোর’ অপবাদই দেয়নি। কান ধরে উঠবোস করিয়ে মারধরও করেছে।
এই ছেলেটির কিশোর মনে এই মানসিক আঘাত সহ্য হয়নি। চুরির অপবাদ হজম করতে পারেনি ছেলেটি। এই অল্প বয়সেই তার মান-অপমান বোধ এত তীক্ষ্ণ যা আজকের দিনে আমাদের বিস্মিত করে! ‘চুরি’ শব্দটা যেন এই কিশোর ছেলেটির কাছে নিন্দিত, ঘৃণিত এবং একটি পাপ কর্মের প্রতীক ছিল। তাই এই চুরির মিথ্যে কলঙ্ক থেকে মুক্তির জন্য মা’কে চিঠিতে জানিয়ে আত্মহত্যার চরম পথটি বেছে নিল সে।
আর! অন্যদিকে দেশের বিশেষ করে আমাদের রাজ্যের সরকার প্রশাসন, নেতা-নেত্রীর নানা কীর্তিকাহিনি ঘটনায় কি আমাদের মনে হয়— ‘চুরি’ একটি গর্হিত অপরাধ, চুরি করা মহাপাপ! বাল্যশিক্ষায় তো এই উপদেশই ছিল। তাই না? এই উপদেশ নীতিবাক্য আজ কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। নইলে আমাদের এই রাজ্যের সর্বত্র ‘চুরি’ যেন এক মহামারীর আকার ধারণ করেছে! এই রাজ্য এবং রাজ্য সরকারের গোপন অ্যাজেন্ডা এবং মহৎ নীতি যেন— ‘চুরি সত্য, চুরি ধর্ম, চুরি-ই মোক্ষ কেবলম।’ নইলে রাজ্য সরকারের মন্ত্রী, নেতা-নেত্রী, সঙ্গী-সাথিদের মধ্যে ‘চুরি’ করার ভাইরাস কোথা থেকে এল? তাই ভাবতে বিস্ময় লাগে মেদিনীপুর তমলুকের কিশোরটি কি কোনও ভিন্ন গ্রহের জীব!
নইলে আমাদের দেশে বিশেষ করে হতভাগ্য এই রাজ্যে বেশ কয়েক বছর ধরে নতুন এই বর্তমান সরকার গদি দখল করার পরেই ‘চুরি’ করাটা মহামারীর আকার ধারণ করল! মন্ত্রী, নেতা-নেত্রী, অন্যান্য বিভিন্ন দপ্তরের আধিকারিক পুলিশের একটা বড় অংশ এবং জাতির মেরুদণ্ড যে শিক্ষা এবং শিক্ষাজগৎ সেখানেও ‘চুরি’র ছোঁয়াচে রোগ থেকে রেহাই পেল না।এই ‘চুরি’ মাহাত্ম্য কত যে বিচিত্র রূপ ধারণ করল! রাজ্যের জনগণকে পুনরায় একটু স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক তাদের জঙ ধরা স্মৃতিটাকে চনমনে করে তোলার জন্য।
রাজ্যে নতুন সরকারের আগমনের পরই দুঃসাহসিক ‘চুরি’র প্রথম হাতে খড়ি দেখি — ‘সারদা’, ‘নারদ’, ‘রোজভ্যালি’— ইত্যাদিতে। বলা যায় চোরের উপর বাটপাড়ি করে কোটি কোটি টাকা সরকারের বড় বড় মাথাদের পকেটে চলে এল! সেই উল্লেখযোগ্য গর্হিত চুরির টাকা জেতাদের হাত পেতে নেওয়ার সুদৃশ্য ও পত্র-পত্রিকায় টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেল! রাজ্যবাসীর সে সব রোমাঞ্চকর ঘটনা নিশ্চয় মনে আছে!
তারপর! সরকারের দলের আতিপাতি নেতারা ও মহাজন পথে গমন করার অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে চুরির মহোৎসবে ময়দানে নেমে পড়ল। সে চুরি যে কত বিচিত্র— রাজ্যবাসী তা প্রত্যক্ষ করল। যেমন — বালি চুরি, কয়লা চুরি, গোরু চুরি, জমি চুরি, আবাস যোজনার টাকা চুরি, একশো দিনের কাজে চুরি, পঞ্চায়েতে চুরি, উন্নয়নের টাকা চুরি, রেশনের খাদ্য চুরি, বনের গাছ চুরি, কাঠ চুরি, রাস্তার গাছ কেটে চুরি, হাসপাতালে ওষুধ চুরি, যন্ত্রপাতি চুরি— যেন চুরির মহামহোৎসব!আর! শেষে কি না জাতির মেরুদণ্ড যে শিক্ষা শিক্ষাজগৎ, সেখানেও রেহাই মিলল না। সেখানেও তথাকথিত শিক্ষিত চোরেরা চুরির মতো গর্হিত কাজে অক্লেশে নেমে পড়ল।
শিক্ষা দপ্তরের মারাত্মক সর্বনাশা দুর্নীতির মাশুল গুনতে হচ্ছে হাজার হাজার ভাবী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। এই সব ছেলেমেয়েরা দুর্নীতির বলি হয়ে সরকার কোর্টের কাছে বিচার চেয়ে মানসিক যন্ত্রণায় পথেঘাটে ঘুরছে। রাজ্যের সর্বত্র এই দুর্নীতির সঙ্গে কি কেবল সাধারণ নেতা-নেত্রী জড়িত? মন্ত্রী, এমপি, এমএলএ, মেয়র, পুলিশকর্তা এরাও নীতিহীন কাজে কি করে যুক্ত থাকেন? এ কেমন সরকার কেমন তার দল, কেমন দলের এসব নেতা-নেত্রী? এরা সব রাজনীতির কলঙ্ক।
‘সারদা’, ‘নারদ’, ‘রোজভ্যালি’র ঘুষের টাকা কে কিভাবে নিয়েছে রাজ্যবাসী দেখেছেন নিশ্চয়।
এই অপরাধের গন্ধ পেয়ে সিবিআই, ইডি অবশ্য পেছনে লেগে গিয়েছিল। তার ফলে লোক দেখানো একজন এমপি’র আর একজন অভিনেতা এমএলএ’র জেলও হয়। বেশ কিছুদিন জেলের ঘানি টেনে জামিন পেয়ে আবার সংসদে দলের মুখপাত্রও হয়ে যান।
তারপর! ‘বালি চুরি’, ‘কয়লা চুরি’, ‘গোরু চুরি’র নায়করা মাঠে নামে। রাজ্যে তখন ‘চুরি’-র বাম্পার ফসল ফলতে লাগল। চারিদিকে কেবল ‘চুরি’ উৎপাদন! ‘চুরি’ আর ‘গুন্ডাগিরি’ এ রাজ্যের উন্নয়নের মুখ হয়ে উঠল। গুন্ডাগিরির প্রেরণা এল স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায়।
তার অনুপ্রেরণায় যারা ‘চুরি’ গুন্ডাগিরিতে রাজ্যে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে— তাদের মধ্যে বীরভূমের বাঘ, মুখ্যমন্ত্রীর প্রিয় ভাই কেষ্ট— অনুব্রত মণ্ডল। কিন্তু পাপ যে বাপকেও ছাড়ে না— গোরু চুরির মাস্টারমাইন্ডকে যেতে হলো তিহার জেলে। বাঘ যেন এবার বিড়াল! সে তার ঘরেও অসৎ নীতির দীক্ষা দিতে পেরেছিল। মেয়েকে স্কুলের চাকরি দিয়েছিল বটে। কিন্তু স্কুলে যেতে হত না মেয়েকে। হাজির খাতা বাড়িতে চলে আসত। বাড়ি বসেই স্কুলে উপস্থিত! মাসে মাসে সরকারের ট্রেজারি থেকে বেতনের চেক ও বাড়ি এসে যেত।
আর এক মহান খাদ্যমন্ত্রী। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক! মুখ্যমন্ত্রীর প্রিয় ভাই বালু। রেশনের খাদ্য চুরিতে ইডি তাকে ধরে জেলে ঢোকালো। কিন্তু পরে জামিনও পেয়ে গেল।
একটা মজার বিষয় এইসব কীর্তিমান নেতারা ধরা পড়লেই হঠাৎ কেমন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের আশ্রয় খোঁজে। এ প্রসঙ্গে কালীঘাটের বিখ্যাত কাকুর কথাও বলা যায়। তার বিরুদ্ধে ভয়ানক অভিযোগ— স্কুল শিক্ষকদের বেআইনি চাকরি বিক্রির কোটি কোটি টাকা নাকি দলের নানা এজেন্টের মারফতে তার কাছে এসে জমা পড়ত। সেই টাকা আবার কোনও বড় মাথার কাছে পৌঁছে দিতে হতো তাকে। সেই বড় মাথা নাকি কাকুর ‘বস’ হয়। ‘বস’ রহস্য নিয়ে অবশ্য সিবিআই, ইডি এখনও হাবুডুবু খাচ্ছে। সেই মাথা দিব্যি হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছে।
এবার আসা যাক সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর শিক্ষা দপ্তরে। সরকারের শিক্ষাদপ্তরের প্রাধান্য সবার উপরে থাকার কথা। শিক্ষাই তো মনুষ্যত্বের মূল কাঠামো। কিন্তু এ রাজ্যের সেই পবিত্র শিক্ষা ক্ষেত্রটাকেও এই সরকার দুষিত করে ফেলল। এখানেও চুরির তীর্থ ক্ষেত্র করতে পিছপা হলো না। টাকার বিনিময়ে শিক্ষকদের কাছে চাকরি বিক্রি। তাও গোপন পথে অযোগ্য প্রার্থীদের টাকার বিনিময়ে শিক্ষক করে দেওয়ার গর্হিত অনৈতিক কাজ। ভাবুন!
মহান শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি এখনো জেলে। প্রাথমিক ‘স্কুল সার্ভিস কমিশনের মানিক ভট্টাচার্য সপরিবারে জেল খেটে এখন জামিনে। স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্রাক্তন চেয়াম্যান প্রাক্তন ডায়মন্ডহারবার কলেজের প্রিন্সিপাল, থেকে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুবীরেশ ভট্টাচার্য— অন্যান্য শিক্ষা আধিকারিকদেরও জেলে যেতে হয়েছে। সুবীরেশ ভট্টাচার্য এখনো পার্থ চ্যা টার্জির মতই জেলের ভেতরে।
এখন প্রশ্ন, এরা চাকরি ‘চুরি’ করে কোটি কোটি টাকার বিপুল অর্থ কার স্বার্থে সংগ্রহ করলেন? এই শিক্ষিত জনেরা শিক্ষার সঙ্গে জড়িত এই মানুষগুলো এমন বিবেকহীন নীতিহীন, আদর্শহীন কু-কাজ কেন করলেন। কার জন্য করলেন? একবারও তাদের শিক্ষিত বিবেক বোধে নাড়া দিল না এমন জঘন্য চুরির সঙ্গে যুক্ত হতে?
আমাদের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যবাসীর মনের ভেতর কি এই বিস্ময় জাগে না যে এই রাজ্যেরই একটি কিশোর বালকের সামান্য একটি চুরির মিথ্যা অপবাদে যদি তার সমস্ত চৈতন্যকে নাড়া দিতে পারে। চুরির অপবাদ তার মান-সম্মানে ভিত নাড়িয়ে দেয়— চুরি যে একটা গর্হিত অপরাধ— এই বিবেক বোধে কিশোরটি যদি আত্মহুতি দিতে মার কাছে তার সত্য স্বীকারোক্তি দিতে পারে। জানিয়ে যেতে পারে সে ‘চুরি’র মতো এমন ঘৃণ্য অপরাধ সে করেনি। আর! এই রাজ্যের বর্তমান সরকার তার দলের মন্ত্রী, নেতা-নেত্রীদের ‘চুরির মতো গর্হিত অপরাধ করতে একটুও বিবেকে লাগে না! তাদের মধ্যে একজনও আজ পর্যন্ত দেখা গেল না যে সাহস করে নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকতে পারে না? এই সৎ সাহসী মেদিনীপুরের কিশোরটির মতো নিজের সরকার, দলের এই সব গর্হিত অন্যায়, অপরাধ— রাজ্যটার ক্ষতি, সর্বনাশ হওয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নিজের মনুষ্যত্বকে সম্মানের আসনে বসাতে পারে না?
না। এই সরকার এবং সরকারের দলটার এমন কোনও সৎসাহসীর দেখা মিলল না! রাজ্যটার সর্বনাশ এরা করেই ছাড়বে মনে হয়। ‘সততার প্রতীক এখন ভাঁওতা বাজির ফানুষ প্রমাণিত। কিন্তু রাজ্যবাসী! তারা কি রাজ্যের সর্বনাশ মেনে নেবেন— তাদের সন্তান-সন্ততির সর্বনাশ মেনে নেবেন।
নাকি চোর তাড়ািয়ে রাজ্যকে বাঁচাবেন!
Comments :0