Criminals and Campus

ক্যাম্পাসে ক্রিমিনালরাজের নতুন চিত্রনাট্য

উত্তর সম্পাদকীয়​

দেবাঞ্জন দে

চিত্রনাট্য লেখা ছিল আগেই। অপেক্ষা ছিল সুযোগ বুঝে মঞ্চস্থ করার। গোটা রাজ্যের অধিকাংশ কলেজ ক্যাম্পাসেই অবৈধ ইউনিয়নকে পাথেয় করে জাঁকিয়ে বসে আছে তৃণমূল পোষিত একদল অপরাধী-দুষ্কৃতী। তাদের মাধ্যমেই কলেজে কলেজে সংগঠিত হয় কাটমানি সিন্ডিকেট। শিক্ষার্থীদের চুপ করিয়ে রাখতে চলে অবাধ থ্রেটবাজি। প্রয়োজনে যতো গুচ্ছ অপরাধ সম্ভব, সে সবও প্রয়োগ হয়। এই সার্বিক ক্রিমিনাল-লুম্পেন-কাটমানি সিন্ডিকেটের সম্পূর্ণ বাইরে যাদবপুরের মতো একটা ঐতিহ্যবাহী ক্যাম্পাসের থেকে যাওয়াটাই মেনে নিতে পারেনি এই সিন্ডিকেটের পান্ডারা। অস্থির করে তুলেছিল ওদের। তাই যাদবপুর দখল করতে মরিয়া প্রচেষ্টা খোদ শিক্ষা মন্ত্রীর নেতৃত্বে। শিক্ষা মন্ত্রী যে পেশায় নাট্যকার। রাজনৈতিক হটস্পট যাদবপুর দখল করতে আপাত বিশ্বাসযোগ্য চিত্রনাট্য আর কেই বা লিখবে তৃণমূলে! অতঃকিম...

ক্রাইম প্লটের নিপুণতা হার মানাবে প্রফেসর মরিয়ার্টিকেও। শুরুতেই রাজ্যের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা স্থগিত করিয়া 'মাননীয়'(!) শিক্ষা মন্ত্রী তৃণমূলের মিটিং ডাকলেন। জেরবার হলো রাজ্যের ছাত্র-ছাত্রীরা। আচমকা শিডিউল পরিবর্তন হওয়াই মুশকিলে পড়ল তারা। তারপর ওয়েবকুপার মিটিং ডাকলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। হাজারো নিষ্ফলা প্রচেষ্টাতেও রাজ্যের ক্রাইম সিন্ডিকেটের মধ্যে যাদবপুরকে না আনতে পারার গ্লানি ঘোচাতে তিনি বেছে নিলেন যাদবপুর। অধ্যাপক সংগঠনের মিটিংয়ে দেখা গেল ঢুকে বসে আছে মধ্যমগ্রামের ক্রাইম সিন্ডিকেটের মাতব্বর থেকে দক্ষিণ কলকাতার কলেজ ক্যাম্পাসের দাগী ক্রিমিনালরা। কোন উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হলো তথাকথিত অধ্যাপক সংগঠনের মিটিং? শয়ে শয়ে দুষ্কৃতী ঢুকিয়ে তাদের তদারকিতে সারছিলেন অধ্যাপকদের মিটিং? শিশু ভোলানো গল্পও হার মানবে এহেন অধ্যাপকদের সম্মেলন দেখে। জলের মতো স্পষ্ট,  অশান্তি পাকাতেই আটঘাট বেঁধে আসরে হাজির হয়েছিলেন শিক্ষা মন্ত্রী। শুরু থেকেই উদ্দেশ্য ছিল যেনতেন প্রকারেণ হট্টগোল তৈরি করা। আর সেই সুযোগে ঝোপ বুঝে কোপ মারবেন তিনি। তাঁর এক ইশারায় বহিরাগত গুন্ডারা দখল নেবে যাদবপুরের। নিঁখুত চিত্রনাট্য।

পরিকল্পনামাফিক যাদবপুরে প্রবেশ করেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে থাকলেন তিনি। উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতেই ডেকে আনলেন প্রেস। মনগড়া গল্প ফেঁদে নিজেকে ভিক্টিম প্রতিপন্ন করতে চাইলেন। মিডিয়াতে সম্প্রচারিত হতে শুরু করল সেই বানোয়াট গল্প। ময়দানে নামালেন নিজের দলের আইটি সেলকে। প্রচার করালেন ছাত্রদের নৈরাজ্যে হেনস্তার শিকার হয়েছেন এক অধ্যাপক। অথচ সেই অধ্যাপককে চিকিৎসা করাতে দেখা গেল না পিজি হাসপাতালে। কল্পকাহিনি যে বেশিক্ষণ ধোপে টিকবে না, বোধ করি এমন আঁচ পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল নিজের ফাঁদা উত্তেজনা নিরস্ত করার। কিন্তু তা করতে গিয়ে যে কাণ্ডটি তিনি ঘটালেন তার সুচারু ভঙ্গিমা দেখে কিন্তু সন্দেহ করতেই হয় যে সেটাও পূর্বপরিকল্পিত কি না। ভিডিও ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ঠান্ডা মাথায় ছাত্রের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। খুনটাও কী চিত্রনাট্যের অংশ ছিল? ক্রিমিনাল সিন্ডিকেটের অন্যতম মূলচক্রীর ক্রিমিনাল ভেন্ট অব মাইন্ড থাকা অস্বাভাবিক তো নয়ই, বরং প্যাথোলজিকাল ক্রিমিনাল হওয়াই দস্তুর। বিপাকে পড়ে হয়তো দাঁত নখ বেরিয়ে এসেছিল সেই ক্রিমিনাল সত্তার। স্মরণে ছিল সঙ্ঘের প্রশিক্ষণ। একেবারে লখিমপুর খেরির পুনরাবৃত্তিতে ছাত্র খুনে নিবৃত হলেন। আহত হলো একাধিক ছাত্র-ছাত্রী। উনি রইলেন সুস্থ অক্ষত।

পিজি হাসপাতালে পৌঁছানোর পর দেখা গেল শিক্ষা মন্ত্রীর অভিনেতা নির্দেশক রূপ। ইষৎ খুঁড়িয়ে, চোখমুখ বিধ্বস্ত অবস্থায় পিজি হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে ঢুকলেন। অক্ষত শরীরে গাড়িতে উঠে, ছাত্র চাপা দিয়ে পিজি পৌঁছে রীতিমতো অসুস্থতার ভান। সেখানেও ওঁকে ঘিরে রয়েছে সেই ক্রিমিনাল চক্র। কুণাল ঘোষ উত্তেজনার বশে বলেই ফেললেন 'গুড় বাতাসা ট্রিটমেন্টের' কথা। আরোও পরিষ্কার হয়ে গেল ঠিক কোনও কারণে সদলবলে যাদবপুরে হানা দিয়েছিলেন শিক্ষা মন্ত্রী। সন্ধ্যাবেলা ব্রাত্যর অপকর্ম ঢাকতে তৃণমূল জনাকয়েক লোককে নিয়ে মিছিল বের করতে দেখা গেল, সেই মিছিলের নেতাদের মুখেও শাসানির সুর। এখনও বছর ঘোরেনি আর জি কর কাণ্ডের। থ্রেট কালচারের ভয়াবহতার বহুবিধ চর্চার ফাঁকেই প্রকাশ্য রাস্তায় মূলস্রোতের মিডিয়ার সামনেই থ্রেট কালচার অনুশীলন করলেন নির্বাচিত 'জনপ্রতিনিধি'রা। দলদাস পুলিশের মুখে কুলুপ আঁটা থাকবেই, কিন্তু সংবাদ মাধ্যমগুলোও কেমন বেমালুম এড়িয়ে গেল ভয়ঙ্কর ঘটনাটি।

যাদবপুর দখলে নেওয়ার পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা ছকেই ক্যাম্পাসে ঢুকেছিল ব্রাত্য। আমাদের রাজ্যে ক্যাম্পাস দখলের ঘটনা এগারো পরবর্তী জামানায় নতুন কিছু না। কিন্তু প্রতিবারই দেখা গেছে এই ধরনের দখল অভিযানে নেতৃত্ব দেন স্থানীয় গুন্ডা মাতব্বররা। কিন্তু এবারে কেন এতটা মরিয়া হয়ে স্বয়ং শিক্ষা মন্ত্রী অবতীর্ণ হলেন দখলদারিত্বের খেলায়! নিজের ক্রিমিনাল সত্তা জনসমক্ষে উন্মোচিত হয়ে যেতে পারে, এমন ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও কেন পিছপা হলেন না তিনি? উত্তর খুঁজতে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে বিগত দেড় দশকের দিকে। বাংলার শিক্ষাব্যবস্থার সম্পূর্ণ সর্বনাশ সাধিত হয়েছে এই দেড় দশকে। একদিকে সরকারি শিক্ষার কাঠামো ধ্বংস করা হয়েছে তিলেতিলে। অন্যদিকে সরকারি শিক্ষার পরিবেশ এবং অংশগ্রহণ নষ্ট করা হয়েছে। সেই সর্বনাশকল্পে অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ কেন্দ্র কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। উচ্চশিক্ষায় খরচ বেড়েছে নির্বিচারে। কলেজে পড়তেই হিমশিম খাচ্ছে রাজ্যের সিংহভাগ শিক্ষার্থী। তদুপরি উচ্চশিক্ষার পরিবেশ ধ্বংস করার নানাবিধ পদ্ধতি প্রযুক্ত হয়েছে ক্যাম্পাসে। যে ছাত্রসংসদ ছাত্রদের কণ্ঠস্বর রূপে কাজ করতো। ছাত্র-ছাত্রীদের আশা আকাঙ্ক্ষা নিবারণের মঞ্চ হয়ে উঠতো। কারিকুলামের পঠনপাঠনের বাইরে বিতর্ক-আলোচনার মধ্য দিয়ে বৌদ্ধিক ও মানসিক বিকাশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পালন করতো; ক্ষমতায় এসেই তৃণমূল কংগ্রেসের নজর পড়ে সেই ছাত্র সংসদের দিকে। ২০১৩ সালে ছাত্র সংসদ নির্বাচন তুলে দেওয়ার প্রস্তাবিত নির্দেশিকা জারি করেন ব্রাত্য বসু্। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে কমরেড সুদীপ্ত গুপ্তের শাহাদাতের বিনিময়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন সে যাত্রায় রক্ষা  করা গেছিল। পরবর্তীতে ছাত্র সংসদগুলিকে গায়ের জোরে বহিরাগত গুন্ডাদের সাহায্যে দখল করার চেষ্টা করতে থাকে তৃণমূল। দখল করা ছাত্র সংসদগুলো হয়ে ওঠে তৃণমূল পোষিত ক্রিমিনালদের সমাজবিরোধী কার্যকলাপের পীঠস্থান। কলেজে ভর্তির সময় কাটমানি খেয়ে সেই টাকায় ক্যাম্পাসে অশালীন সংস্কৃতির দেদার আমদানি শুরু হয়। থ্রেট কালচার থেকে শুরু করে রেপ কালচারের চাষ শুরু হয়ে যায়। ছাত্র সমাজের নিরাপত্তা রক্ষার ছাত্র সংসদ পরিণত হয় ছাত্র সমাজের নিরাপত্তাহীনতার আখড়ায়। 
ক্যাম্পাসের গণতান্ত্রিক চেতনা নষ্ট করে কর্পোরেটের খেয়ালখুশিমতো মুল্যবোধে ছাত্র মনন পর্যবসিত করার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা সক্ষম হয় ক্যাম্পাসে। যায় অনুষঙ্গেই জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ প্রয়োগের ভিত্তিভূমি প্রস্তুত হয়। সস্তার শ্রমিক এবং রোবোট তৈরির উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। একইসাথে তৃণমূলের লুটেরা রাজনীতির লক্ষ্যে পর্যাপ্ত ক্রিমিনালদের ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস এবং তার অবৈধ ছাত্র সংসদগুলি।

এই ধ্বংসাত্মক প্রবণতার বৃত্তে যে ক্যাম্পাসগুলোকে  এখনও অঙ্গীভূত করা যায়নি তার মধ্যে অন্যতম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। ফলত সার্বিক স্বৈরাচার কায়েম করে ক্রিমিনাল তৈরির প্রক্রিয়া সর্বোচ্চ করতে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল যাদবপুর সহ মুক্ত চিন্তার আবহ সম্পন্ন ক্যাম্পাসগুলি। ইতিমধ্যেই এসএফআই’র নেতৃত্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে বাংলাজুড়ে দুর্বার আন্দোলন শুরু হয়েছে। এসএফআই কর্মীরা নতুন উদ্যমে রণসজ্জায় সজ্জিত হচ্ছে ছাত্র সংসদে গণতান্ত্রিক ভিত্তি পুনপ্রতিষ্ঠা করতে। আর তাতেই সিঁদুরে মেঘ দেখেছে তৃণমূল। আশঙ্কিত তৎপরতায় আচ্ছন্ন হয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু।

ছাত্র সংসদ নির্বাচনের লড়াই রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা বাঁচানোর সর্বব্যাপী লড়াইয়ের প্রথম ধাপ। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেই গণশিক্ষার মৌলিক কাঠামো রক্ষা করার ব্লু প্রিন্ট রচনা করছে এসএফআই। শিক্ষা থেকে ছিটকে যাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাঙ্গনে ফিরিয়ে এনে সর্বজনীন শিক্ষার স্বপ্ন ফেরি করছে। যা দেখে কপালে ভাঁজ পড়ছে শিক্ষার কারবারিদের। ভ্রুকুটি করছে ক্রিমিনাল সিন্ডিকেটের মাতব্বররা। ক্যাম্পাস থেকে ক্রিমিনাল সিন্ডিকেট বন্ধ হয়ে গেলে পাততাড়ি গোটাতে হতে পারে সমগ্র তৃণমূল কংগ্রেসকেই। তাই সাততাড়ি পুরোদস্তুর পরিকল্পনা নিয়ে যাদবপুরের রণাঙ্গনে হাজির হয়েছিলেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলা ক্রিমিনাল সিন্ডিকেটের হেড ক্রিমিনাল ব্রাত্য বসু। যাদবপুর থেকে শুরু করতে চেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন  মুক্তচিন্তার ঐতিহাসিক কেন্দ্রে আঘাত হানলে আরও সহজ হয়ে যাবে বাংলা জুড়ে ক্যাম্পাস দখল প্রকল্প। দমিয়ে দেওয়া যাবে আন্দোলন।

কিন্তু, যাদবপুরেই ফ্লপ খেয়ে গেছেন চিত্রনাট্যকার ব্রাত্য। যাদবপুরের ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে পড়ে নাটক করে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। শেষ কামড় হিসাবে ছাত্র খুনের চেষ্টাও করলেন। কিন্তু নিজেদের তৈরি করা কল্পজগতের ফানুসে ভাসতে ভাসতে ওঁর অগোচরে রয়েগেছিল বাংলার ছাত্র আন্দোলনের চলমান অধ্যায়ের অনন্যতা। এক অন্য সময়ে প্রবেশ করেছে বাংলার ছাত্র আন্দোলন। ছাত্র সমাজের ঠিকানা ক্যাম্পাস বহিরাগত গুন্ডারা দখল করতে এলে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিরোধের নতুন আখ্যান রচনা করছে এখনকার ছাত্ররা। প্রাণের পরোয়া না করে মাটি আঁকড়ে রক্ষা করছে ক্যাম্পাস। যাদবপুর আটকালো ব্রাত্য বসুকে। শিক্ষামন্ত্রীর গ্রেপ্তারির দাবিতে একদিন পরে রাজ্যজুড়ে এসএফআই’র ডাকা ছাত্র ধর্মঘটের দিনে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে সর্বাত্মক ধর্মঘট হলো ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, অভিভাবকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে। পুলিশ প্রশাসন গুন্ডা অস্ত্রসস্ত্র সমস্ত কিছু সহযোগে ক্যাম্পাসে হামলা করেও এসএফআই’র স্পর্ধিত মেজাজে ভীত হয়ে পিছু হটল ক্রিমিনাল সিন্ডিকেট।

প্রতি ইঞ্চিতে যুদ্ধ আঁকা চলছে!
যুদ্ধ শেষতক। ক্রিমিনালরাজ শেষ করবোই।

একটা নতুন সময়ে এসে পৌঁছেছি আমরা।
যুদ্ধের সময়। হ্যাঁ, যুদ্ধের সময়।
বেঁচে থাকার সমস্ত রসদ এই সময়টার মধ্যেই আছে।

Comments :0

Login to leave a comment