মোদী সরকারের কোনও না কোনও প্রতিনিধির মুখ থেকে প্রায় প্রতিদিনই চীন বিরোধী হুঙ্কার শোনা যায়। চীন-ভারত দ্বন্দ্ব বা বিরোধকে জোরালো ও ঝাঁঝালো করার লক্ষ্যে মোদী প্রিয় সংবাদমাধ্যম প্রতিদিনই বড় বড় খবর প্রচার করে। সম্পাদকীয় মতামত বা বিশেষজ্ঞের আলোচনায় নিত্য কাঠগড়ায় তোলা হয় চীনকে। চীন বিরোধী জিগির শাসক দল ও তাদের অনুগামীদের তরফে এমনভাবে তোলা হয় যাতে মনে হবে ভারতে চীনের নাম উচ্চারণ করাও দেশ বিরোধিতার শামিল। এমন এক আবহ রাজনৈতিক মহলে তৈরির চেষ্টা হচ্ছে যেন চীন ভারতের চরমতম শত্রু। চীন সম্পর্কে কেউ সামান্যতম নরম মনোভাব যুক্তির আলোকে প্রকাশ করলেও তাকে চীন পন্থী বা দেশের শত্রু বলে দেগে দেবার উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রবণতা প্রকট হয়ে উঠছে।
প্রতিবেশী দেশ হিসাবে চীনের হাজার মতবিরোধ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকলেও দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক শিথিল হয়নি। ভারত চীনকে শত্রু দেশ হিসাবে ঘোষণা করেনি। আন্তর্জাতিক নীতি নিয়ম মেনে দু’দেশের মধ্যে সব ধরনের যোগাযোগ, আদান-প্রদান চালু আছে। দু’দেশের দূতাবাস দু’দেশে স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে। দু’দেশের নাগরিকদের দু’দেশে যাতায়াত চলছে। চলছে সব ধরনের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যও চলছে যথারীতি। তাহলে সমস্যা হলো রাজনীতিতে। এই রাজনীতি হিন্দুত্ববাদী, উগ্রজাতীয়তাবাদী রাজনীতি।
দেশের অভ্যন্তরে শাসক বিজেপি’র রাজনৈতিক প্রচারের অন্যতম ইস্যু উগ্র দেশপ্রেম। দেশ প্রেমের জিগির তুলে রাজনীতির হাওয়া নিজেদের দিকে ঘোরানোর জন্য একটা যুৎসই শত্রুকে খাড়া করতে হয়। শুধু পাকিস্তান দিয়ে সে কাজ সহজ হচ্ছে না বলে জরুরি হয়ে পড়েছে চীনের মতো একটা বড়সড় শক্তিকে সামনে হাজির করা। চীন শত্রু হলে তার বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়া যায়, গরম গরম ভাষণ দেওয়া যায়। তেমনি একদিকে সক্রিয়তা বাড়লে উলটো দিকেও সক্রিয়তা বাড়ে। তখন বিরোধ জটিল হয়। আর যদি প্রতিবেশীদের মধ্যে উভয়ের সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলার তাগিদ থাকে তাহলে আখেরে লাভবান হয় দু’দেশই। তিক্ততার, বিরোধিতার ও শত্রুতার সম্পর্ক যত বাড়বে ততই সরকারের খরচ বাড়বে সামরিক, কূটনৈতিক বৈদেশিক খাতে। মার খাবে উন্নয়ন, সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার প্রত্যাশা পূরণ। হিন্দুত্ববাদী শাসকের কাছে সাধারণ মানুষ গৌণ। মুখ্য ভোট, ক্ষমতা। উগ্রজাতীয়তাবাদী ঝড় তুলে দেশ রক্ষার জন্য শাসকের পেছনে জনগণকে শামিল করতে এর থেকে ভালো রাস্তা বিশেষ নেই। অর্থনীতি সহ অন্য সব ক্ষেত্রে ব্যর্থ মোদী সরকারের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে উগ্রজাতীয়তাবাদ ও কট্টর দেশপ্রেম ছাড়া বিকল্প নেই। ক্ষমতায় টিকে থাকতে তারা সেই কাজই করে যাচ্ছে।
প্রচারের ঝাঁঝে চীন যত বড় শত্রুই হোক না কেন বাস্তবের আঙিনায় দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে কোনও খামতি নেই। চীনের পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ, কড়াকড়ির যত প্রচারই হোক বা চীনের বিনিয়োগ যত নিয়ন্ত্রণ লাগু হোক দু’দেশের বাণিজ্য কিন্তু হু হু করে বেড়ে চলেছে। বস্তুত মোদী জমানাতেই এর গতি বেড়েছে। প্রচারে শত্রুতা থাকলেও অর্থনীতির বাস্তবতায় চীন ছাড়া ভারতের অর্থনীতি এগোবার সুযোগ কম। ভারতীয় কর্পোরেট চায় না চীনের সঙ্গে তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হোক। কর্পোরেট বান্ধব মোদী সরকার তাই কৌশলের আশ্রয় নিয়ে চীন বিরোধিতার আড়ালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের গতি বাড়িয়ে চলেছে। তথ্য বলছে মোদী আমলেই চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের আয়তন বেড়েছে। ২০২২ সালে ভারত-চীন বাণিজ্য সর্বকালীন রেকর্ড ১৩৫০০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। পাশাপাশি ভারতের ঘাটতিও ১০ হাজার কোটি ডলার অতিক্রম করেছে। ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৭৫ শতাংশ বেড়েছে। ভারতের তথাকথিত মিত্র দেশগুলির সঙ্গে প্রতিনিয়ত বাণিজ্য চুক্তির খবর প্রচারিত হলেও বাস্তবে তাদের থেকে বেশি গতিতে বাণিজ্য বাড়ছে চীনের সঙ্গে। অথচ চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের খবর সংবাদমাধ্যমে দেখা যায় না।
Editorial 17 th January
এ কেমন শত্রু?
×
Comments :0