Editorial

ঘরোয়া সঞ্চয়ে বিদেশি দখলদারি

সম্পাদকীয় বিভাগ

দেশের স্বনির্ভরতা ও অর্থনীতির বুনিয়াদ গড়ে তোলার সম্পদ স্বরূপ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলিকে বেসরকারিকরণে মোদী সরকার দ্রতগতিতে এগচ্ছিলই। বিদেশি বহুজাতিকদের কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছিল দেশের বুনিয়াদি শিল্প এবং পরিষেবাক্ষেত্রগুলিকে। এবার রেহাই মিলল না বিমা শিল্পেরও। লোকসভা এবং রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় সরকার যে বিমা আইন সংশোধনী পাশ করিয়েছে তার ফলে বিমা শিল্পে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের আর কোনও উর্ধসীমা থাকলো না। এর আগে বিমা শিল্পে সর্বোচ্চ ৭৪ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ অনুমোদিত ছিল। নতুন আইন অনুসারে ১০০ শতাংশ বিনিয়োগই করতে পারবে বিদেশি পুঁজিপতিরা। বিরোধীদের তুমুল আপত্তি অগ্রাহ্য করেই মোদী সরকার নতুন বিল পাশ করিয়ে নিয়েছে। নামে ‘সবকা বিমা সবকি রক্ষা বিল’ হলেও ভারতবাসীর সবার স্বার্থরক্ষা নয়, বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলির মুনাফা লোটার রাস্তা খুলে দিল মোদী সরকার। 
‘জীবন বিমায় রাষ্ট্রের অত্যধিক নিয়ন্ত্রণের কোনও প্রয়োজন নেই। বরং যত বেশি প্রতিযোগিতা তত বেশি লাভ!’ লোকসভায় এমন কুযুক্তি দিয়ে, মোদী সরকারের অর্থ মন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বিমা আইন সংশোধনী বিল পাশ করান। বাস্তবে বিমা এবং ব্যাঙ্ক শিল্পের রাষ্ট্রায়ত্তকরণের পিছনে উলটো যুক্তি ছিল। দেশের মানুষের গচ্ছিত সম্পদকে নিরাপদ রাখা এবং সেই সম্পদের ব্যবহারে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ঘটানো অর্থাৎ উন্নয়নের জন্য পুঁজির সংস্থান করা হয়েছিল ব্যাঙ্ক এবং বিমা শিল্পের রাষ্ট্রায়ত্তকরণের মাধ্যমে। এর সুফলও ভারতবাসী পেয়েছিলেন। এখন বিপদ দু’দিকেই, কারণ দেশবাসীর গচ্ছিত সম্পদ লুট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা যেমন থাকছে, তেমনই দেশের উন্নয়নের জন্য পরিকল্পিত বিনিয়োগের সম্ভাবনাও শেষ হয়ে যেতে চলেছে। ১০০ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে বিমা শিল্পে বড় ধরনের জালিয়াতির সুযোগ বাড়বে। কারণ বিদেশি সংস্থাগুলিকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের সুযোগ কখনোই রাষ্ট্রয়াত্ত বিমা সংস্থাগুলির মতো থাকবে না, তাদের ব্যবসা অবাধ করতে সবরকম সুবিধা দেওয়া হবে, কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থাগুলিকে দিয়ে সরকারে আসীন শাসকদল নিজেদের ভোট পাওয়ার জনপ্রিয় রাজনীতি করবে। দায়বদ্ধতা থাকবে রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের, আর মুনাফা করবে বিদেশি সংস্থা, এভাবে কি সমান প্রতিযোগিতা হতে পারে? এখনও পর্যন্ত লাভজনক রাষ্ট্রায়াত্ত বিমা সংস্থা কি এরপরেও লাভজনক থাকবে? অথবা লাভজনক থাকতে সেকি আর দেশ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা দেখাবে? 
শঙ্কা আরও আছে, বিদেশি সংস্থাগুলির কাছে আমাদের দেশের মানুষকে প্যান কার্ড, আধার কার্ড দিতে হবে। ডিজিটাল সুরক্ষা বিপন্ন হবে আরও বেশি করে। দেশের অসামরিক বিমান পরিবহণ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার আধিপত্য ভেঙে বেসরকারি পুঁজির ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়ার সময়েও কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিযোগিতার ফলে পরিষেবার উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে একচেটিয়া বেসরকারি পুঁজির আধিপত্য কায়েম হওয়ার পরেই বিমান পরিষেবার হাল কী হয়েছে সেটা সম্প্রতি ইন্ডিগো বিপর্যয়ে নগ্নভাবে প্রকাশিত হয়ে গেছে। বিমা শিল্পেও এভাবে মানুষকে বিপর্যস্ত করলে তার প্রভাব আরও বহুগুণ ব্যাপক এবং ভয়ঙ্কর হতে পারে। আমাদের রাজ্যে তৃণমূলের মদতে চিট ফান্ড কারবারে বিপর্যস্ত মানুষজনকে আত্মহত্যা করতে দেখার পরেও যারা বেসরকারি লগ্নির মোহে রয়েছেন তাঁরা জেগে ঘুমোচ্ছেন। বিদেশি বহুজাতিক সংস্থাগুলির বিমা কারবারের রমরমা তৈরি হওয়া মানে শুধু কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাওয়া নয়, দেশের কোটি কোটি মানুষ যে ভরসা নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে অর্থ সঞ্চয় করে রাখেন তাঁদেরও প্রতারণার মুখে ঠেলে দেওয়া।

Comments :0

Login to leave a comment