জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ। দেশের সবথেকে বিত্তশালী তাঁরা। ভারতের এই মুষ্টিমেয় সংখ্যক ধনী-শ্রেষ্ঠরাই দেশের মোট সম্পদের প্রায় ৪১ শতাংশের মালিক। বিপরীতে আর্থিক সক্ষমতার দিক থেকে জনসংখ্যার নিচের দিকের ৫০ শতাংশের হাতে রয়েছে মোট সম্পদের মাত্র ৩ শতাংশ। আবার এই দরিদ্রতম ৫০ শতাংশের কাছ থেকেই সারা বছরে সংগৃহীত মোট জিএসটি’র ৬৪ শতাংশ আদায় করে সরকার। ধনীতম ১০ শতাংশের সেখানে ভাগ মাত্র ৪ শতাংশ। ২০২১ সালের ভারতের ধনী-গরিবের ফারাকের এই নির্মম চিত্র তুলে ধরেছে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান অক্সফাম। দাভোসে সোমবার শুরু হয়েছে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম-এর বৈঠক। সেখানেই সংস্থার তরফে প্রকাশিত এই রিপোর্টে আরও জানানো হয়েছে, ২০২২ সালে ভারতের সর্বাধিক ধনী ১০০ জনের মোট সম্পদের পরিমাণ পৌঁছেছে ৫৪.১২ লক্ষ কোটি টাকায়। সেই ১০০ জনের মধ্যে ধনী-শ্রেষ্ঠ প্রথম দশ জনের মোট সম্পদের পরিমাণই ২৭.৫২ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২-এ এই দশ জনের সম্পদ বেড়েছে ৩২.৮ শতাংশ। এই এক বছরে দেশের শীর্ষ ধনী ব্যক্তি মোদী-ঘনিষ্ঠ গৌতম আদানির একার সম্পদই বেড়েছে ৪৬ শতাংশ।
বিজ্ঞানী ডারউইনের তত্ত্ব বলেছিল ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’-এর (যোগ্যতমের উদবর্তন) কথা, অক্সফামের এই রিপোর্টের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘সারভাইভাল অব দ্য রিচেস্ট’ (ধনী-শ্রেষ্ঠর উদবর্তন)। রিপোর্টে ভারত সংক্রান্ত অংশে শুধু ভারতীয় ধনী বা বিত্তশালীদের সম্পদ বৃদ্ধির চিত্রই তুলে ধরা হয়নি। বলা হয়েছে, করোনার পর্বে ভারতে ধনীরা আরও ধনী হয়েছেন। তত আর্থিক সক্ষমতা কমেছে নিম্নবিত্ত মানুষের। অক্সফাম জানাচ্ছে, ২০১২ সাল থেকে ভারতে যে সম্পদ তৈরি হয়েছে, ক্রমাগত ধনীদের হাতে তার কেন্দ্রীভবন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। পরিণতিতে এখন দেশের জনসংখ্যার ধনীতম ৫ শতাংশের হাতে রয়েছে মোট সম্পদের প্রায় ৬২ শতাংশ, ১০ শতাংশের হাতে রয়েছে মোট সম্পদের ৭২ শতাংশের বেশি এবং এই মোট সম্পদের ৯০ শতাংশই কুক্ষিগত করেছেন ধনীতম ৩০ শতাংশ ভারতীয়। বিশেষত, করোনা মহামারীর সূচনার সময় থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ভারতীয় বিলিওনেয়ারদের (সম্পদের পরিমাণ অন্তত একশো কোটি টাকা) সম্পদের পরিমাণ টাকার প্রকৃত মূল্যে প্রতিদিন বেড়েছে ৩৬০৪ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ১২১ শতাংশ। করোনা মহামারীর পর্বেই ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ভারতে বিলিওনেয়ারের সংখ্যা ১০৬ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৬৬। এই সময়েই দেশে দারিদ্র সীমার নিচে তলিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা পৌঁছেছে ২২ কোটি ৮৯ লক্ষে, যা গোটা বিশ্বে সর্বাধিক।
ভারতের কর কাঠামোকেও কঠোর ভাষায় বিদ্ধ করা হয়েছে অক্সফামের রিপোর্টে। বলা হয়েছে, ভারতের কর ব্যবস্থা ভীষণভাবেই পশ্চাদমুখী। এখানে আয়করের মতো প্রত্যক্ষ কর ধার্য করা আছে আয়ের ভিত্তিতে। কিন্তু জিএসটি ও ভ্যাটের (মূল্যযুক্ত কর) মতো পরোক্ষ কর একই হারে চাপানো আছে সর্বস্তরের জনগণের উপর, সে তাঁদের আয় যা-ই হোক না কেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, ভারত সরকার প্রতি বছর সব ধরনের সামগ্রীর বিক্রি থেকে যে কর সংগ্রহ করে, তার ৬৪.৩ শতাংশই দেন আর্থিক দিক থেকে জনসংখ্যার নিচের স্তরের (গরিব) ৫০ শতাংশ। ধনীতম ১০ শতাংশ আয়ের যত শতাংশ পরোক্ষ কর বাবদ সরকারকে দেন, একই খাতে তার ৬ গুনেরও বেশি পকেট থেকে বেরিয়ে যায় ওই ৫০ শতাংশের। করোনার আগেই ভারত সরকার কর্পোরেট ট্যাক্স বা কোম্পানি করের হার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে করেছিল ২২ শতাংশ। তাতে সরকারের রাজস্ব খাতে ক্ষতি হয়েছিল ১ লক্ষ ৮৪ হাজার কোটি টাকা। সেই ক্ষতি সামাল দিতে সরকার বিভিন্ন সামগ্রীর উপর উৎপাদন শুল্ক ও জিএসটি’র মতো পরোক্ষ করের হার বাড়িয়ে দেয়। তার বোঝা যখন মারাত্মভাবে আঘাত করেছে নিম্নবিত্ত মানুষকে, তখন কোম্পানি কর হ্রাস ও কর ছাড় সহ অন্যান্য আর্থিক সুবিধা (ইনসেনটিভ) থেকে লাভবান হয়েছেন ধনীরা। বাস্তবে এখানে ধনীদের তুলনায় অনেক বেশি করের বোঝা বইতে হয় গরিব ও মধ্যবিত্তকে। তার জেরেই ভারতে অর্থনৈতিক অসাম্য আরও বেড়েছে।
অক্সফাম ধনীদের কাছ থেকে কর বাবদ সম্পদ সংগ্রহে জোর দেওয়ার কথাও জোরালোভাবে বলেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতের ধনীতম ব্যক্তি গৌতম আদানি পরিচালিত শিল্পগোষ্ঠীর ২০১৭-২১’র অবিক্রিত উৎপাদনের উপর এককালীন কর আরোপ করে সরকার সংগ্রহ করতে পারে ১ লক্ষ ৭৯ হাজার কোটি টাকা। তা দিয়ে সারা দেশে ৫০ লক্ষের বেশি প্রাথমিক শিক্ষককে এক বছর বেতন দেওয়া যাবে। দেশের বিলিওনেয়ারদের মোট সম্পদের উপর যদি এককালীন ২ শতাংশ কর ধার্য করা হয়, তাহলে সরকারি কোষাগারে ঢুকবে ৪০ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। তা দিয়ে তিন বছর ভারতে অপুষ্টিতে আক্রান্তদের জন্য পুষ্টি কর্মসূচী পরিচালনা করা যাবে। আবার দেশের সবথেকে ধনী ১০ জনের মোট সম্পদের উপর এককালীন ৫ শতাংশ কর আরোপ করা হলে সরকার পাবে ১ লক্ষ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। তা ২০২২-২৩ সালের জন্য কেন্দ্রের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক ও আয়ূষ মন্ত্রকের মোট বাজেট বরাদ্দের (যথাক্রমে ৮৬ হাজার ২০০ কোটি ও ৩ হাজার ৫০ কোটি টাকা) দেড় গুন। দেশের সমস্ত শিশুকে বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যও এই টাকা যথেষ্ট, যাদের সংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি। দেশের ধনীতম ১০০ জনের কাছ থেকে ২.৫ শতাংশ হারে এককালীন কর বসিয়েও এই টাকা সংগ্রহ করা যেতে পারে। রিপোর্টে অক্সফাম উল্লেখ করেছে, ভারতের বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় লিঙ্গবৈষম্য ও জাতপাতের বৈষম্যও প্রকট। দেশে এক জন পুরুষের এক টাকা আয় পিছু এক জন মহিলার আয় ৬৩ পয়সা। সামাজিক দিক থেকে এগিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীগুলির শ্রমিকদের আয়ের ৫৫ শতাংশ আয় তফসিলি জাতিভুক্ত শ্রমিকদের। আর গ্রামাঞ্চলের শ্রমিকদের আয় শহরাঞ্চলের শ্রমিকদের আয়ের অর্ধেক।
রিপোর্ট সম্পর্কে অক্সফাম ইন্ডিয়ার সিইও অমিতাভ বেহার বলেছেন, বর্তমান ব্যবস্থায় দলিত, আদিবাসী, মুসলিম, মহিলা, নারী ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা সহ প্রান্তিক অংশের মানুষ একটানা কষ্টের মধ্যে আছেন, যে ব্যবস্থা ধনীতমদের অস্তিত্বকে সুনিশ্চিত করেছে। তিনি কার্যকরী পদ্ধতিতে অসাম্য মোকাবিলার জন্য ধনীদের উপর সম্পদ করের মতো কর আরোপ করে প্রগতিশীল কর কাঠামো রূপায়নের আরজিও জানিয়েছেন দেশের অর্থ মন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের কাছে। অন্যদিকে, অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর গাব্রিয়েলা বুচার বলেছেন, প্রচলিত বিশ্বাস হলো, ধনীদের কর ছাড় দিলে তাঁদের যে সম্পদ বাড়ে, বাকি সবার কাছে তার সুফল পৌঁছায়। এই বিশ্বাস ভেঙে বেরিয়ে আসার সময় এখন। বরং অসাম্য কমিয়ে আনা ও গণতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য অতি-ধনীদের উপর কর আরোপই জরুরি। আর সপ্তাহ দুয়েক বাদেই পরবর্তী আর্থিক বছরের জন্য সংসদে বাজেট পেশ করবেন অর্থ মন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। তার আগে অক্সফামের এই রিপোর্ট ভারতীয় অর্থনীতি পরিচালনায় কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ব্যর্থতাকে যেমন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, তেমন সরকারের উপর নিশ্চিতভাবেই চাপও কিছুটা বাড়ালো।
India's inequality Oxfam
অর্থনৈতিক অসাম্যের নির্মম চিত্র অক্সফামের রিপোর্টে
×
Comments :0