অনন্ত আকাশ
আমাদের সরকারের অদূরদর্শিতা ও কমিশন খাওয়ার লোভ, কর্পোরেট ও কোম্পানিগুলির মুনাফার লক্ষ্যে অন্ধ কিন্তু খোলাখুলি লুটে যোশীমঠ আজ নিজের অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছে। একে তো যত্রতত্র বহুতল নির্মাণ হয়েছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ প্রকল্পের দানবীয় পরিকাঠামো, সড়ক, প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলির বিশালাকায় নির্মাণ, সরকারি কর্তৃপক্ষের সচেতনতার অভাব পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটিয়েছে। ভৌগোলিক দৃষ্টি থেকে অত্যন্ত সংবেদনশীল পাহাড়ে পাহাড়ের মতোই উন্নয়নের পথ নেওয়ার কথা। সরকার নিজে তো তা করেইনি, ভূবৈজ্ঞানিকদের পরামর্শ শোনেনি, মিশ্র কমিটির রিপোর্টকে পর্যন্ত পাত্তা দেওয়া হয়নি। পরিস্থিতি এখন এমনই যে শঙ্করাচার্যের তৈরি করা বসতি যোশীমঠের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
পুরানো প্রবাদবাক্য আছে : পাখিতে শস্য খেয়ে যাবার পরে আর চিন্তা করে কী হবে? যখন টানেল বানানো হচ্ছিল, তখন আমরা চুপ করে ছিলাম। যখন বৈজ্ঞানিকরা সতর্ক করছিলেন তখন আমরা চুপ করেছিলাম, যখন পর্যটকরা বারবার সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলেন তখন সরকার দেখেও না দেখার ভান করেছে। ইংরেজ সরকার যা করেনি স্বাধীন ভারতের সরকার তা করেছে। প্রায় পঁচিশ হাজার জনসংখ্যার শহরে নিকাশি এবং স্যুয়ারেজের কোনও পরিকল্পিত ব্যবস্থা করা হয়নি। যেখান সেখান দিয়ে জল চুঁইয়ে মাটি নরম করে দিয়েছে। ধনী ও কোম্পানিরা যা করতে চেয়েছে করতে দেওয়া হয়েছে। মিশ্র কমিটির সুপারিশ চেপে রাখা হয়েছিল সে কারণেই। এখন বিপদ এসেছে, এখন কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ হচ্ছে।
অন্যদের কথা বাদ দিন, এই পীঠের শঙ্করাচার্য সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, তিনি পূর্ববর্তী এবং বর্তমান সরকারকে সমস্যা সম্পর্কে অবগত করলেও তারা গুরুত্ব অনুধাবন করেনি।
২০১৪ সালে শ্রীনগর ও দেরাদুনের নির্বাচনী সমাবেশে মোদী চারধাম সড়কের কথা ঘোষণা করেছিলেন। তখন পাহাড়ের জনতা অভিভূত হয়েছিলেন, ওই ঘোষণার সঙ্গে হিন্দুত্বের স্বাভিমান জাগানোরও চেষ্টা করেছিলেন তিনি। ভোটও পেয়েছিলেন। কিন্তু শীতকালে কেদারনাথ উখিমঠ, বদ্রীনাথ যোশীমঠে এসে থাকেন। এ তাঁদেরও সহ্য হয় না! ঘোষিত পরিবেশবিদদের অনেকেও নীরব ছিলেন। আজ তাঁরাই কাঁদছেন যাঁরা এইসবের জন্য দায়ী। সরকারের ঘোষণা আর শব্দ জালে আচ্ছন্ন থেকে কী ভুল হয়েছে, তাঁরা টের পাচ্ছেন।
যোশীমঠে পৌঁছে প্রতিরক্ষা রাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ভরসা রাখুন, মোদীজী সব কিছু সামলে নেবেন। রাজ্যে নির্বাচিত সরকার রয়েছে, তার তরতাজা মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন, কিন্তু তাদের ওপরে দেশের সরকারের ভরসা নেই। এখন যোশীমঠে বসে বিজেপি পরিস্থিতি ‘ম্যানেজমেন্ট’ ব্যস্ত। সঙ্ঘ পরিবারের লোকেরা বলে বেড়াচ্ছে এই দেবভূমিতে বড় বেশি পাপ হয়ে গেছে, আমরা এইসব পাপ করেছি, সরকার আর কী করবে! এইসব ম্যানেজমেন্ট সত্ত্বেও কর্ণপ্রয়াগ, তেহরি, উত্তর কাশীতে সমানে ধসের খবর আসছে। রেল টানেলে ফাটল ধরেছে, জলবিদ্যুৎ টানেলে জায়গায় জায়গায় জল বেরিয়ে আসছে।
যোশীমঠের পাশেই রৈনি গাঁওয়ে প্রকৃতিকে নির্মম শোষণের বিরুদ্ধে চিপকো আন্দোলন হয়েছে। সেই লড়াইয়ে কমিউনিস্টরাও ছিল। সিপিআই(এম) প্রথম থেকেই বিশালাকৃতির সুড়ঙ্গ কাটার প্রকল্পের বিরোধিতা করে এসেছে। রাস্তা তৈরির জন্য যেখানে সেখানে গাছ কাটা ও পরিবেশতন্ত্রের ক্ষতি করার বিরোধিতা করেছে। দীর্ঘ আন্দোলনও হয়েছে। পিণ্ডার উপত্যকায় জলবিদ্যুৎ নিগমের ২৫২ মেগাওয়াট সুড়ঙ্গ-আধারিত দেবসারী প্রকল্পের বিরোধিতা করা হয়েছে। কেদার উপত্যকায় সিঙ্গৌলি- ভটবাড়ি টানেলেরও সিপিআই(এম) বিরোধিতা করেছে। বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধিতা নয়, যে পদ্ধতিতে এইসব প্রকল্প তৈরি হচ্ছে, তার বিরোধিতা করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও কর্পোরেট সংস্থার স্বার্থে পরিবেশের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ বিরাট বিরাট প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যাওয়া হয়েছে। আজ দেখা যাচ্ছে যেখানেই এই অতি-বৃহৎ পরিযোজনা করা হচ্ছে সেখানেই ভূ-ধস, জলস্রোত শুকিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। ২০১৩ সালে কেদারনাথের বন্যা সম্পূর্ণতই মানুষের তৈরি বিপর্যয়। কেদারনাথের ওপরে চোরাওয়াড়ি জলাশয়ের জল মেঘ ভেঙে নেমে এসে মন্দির সহ চারপাশের রাস্তা, জনবসতিকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এর সঙ্গে টানেলের জল মিশে মন্দাকিনী অভূতপূর্ব রুদ্ররূপ নিয়েছিল। ভেসে আসা পাথর হৃষিকেশ, হরিদ্বার পর্যন্ত আঘাত করেছিল। হাজার মানুষের প্রাণ চলে যাওয়ার পরেও সরকার একে দৈব দুর্বিপাক অ্যাখ্যা দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব আড়াল করার চেষ্টা চালিয়েছে। ২০১৩-র পরে সরকারের উদাসীনতায় বড় সংখ্যার মানুষ কেদার উপত্যকা থেকে পালিয়ে এসেছেন। ২০২১-এ যোশীমঠের তপোবনে টানেলের মধ্যে দু’শ মানুষ প্রবল জলস্রোতে, কাদার নিচে পড়ে মারা যান। এর পরেও সরকারের হুঁশ ফেরেনি। তারপর থেকে পরিবেশবিদ, বামপন্থী দলগুলি, নাগরিক সমাজের একাংশ বারংবার সাবধানবাণী দিচ্ছিল। উত্তরাখণ্ডে তিন সমতল ও দশ পাহাড়ি জেলা রয়েছে। এদের জন্য উন্নয়নের ধারা ও পদ্ধতি পৃথক হওয়া দরকার। অবাধে রিসর্ট, হোটেল, বহুতল নির্মাণ করা হচ্ছে। দেরাদুনের মতো শহরে সমস্ত ব্যবস্থা কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। স্মার্ট সিটি, নতুন শহর ইত্যাদির নাম করে পৌর ব্যবস্থা থেকে যান চলাচল সবই বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।
পাহাড়ে যে বিপর্যয় ঘটছে, তাকে আবেদন-নিবেদনে আটকানো যাবে না। পাহাড় ও পাহাড়ের মানুষকে বাঁচাতে গেলে জন আন্দোলনই একমাত্র ভরসা, সরকারকে নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করার লড়াই গড়ে তোলাই এখন জরুরি।
Comments :0