রায়ের পরে নির্যাতিতার বাবা-মা অভিযোগ তুলেছেন, ‘আমার মেয়ের ওপর এই অত্যাচারের ঘটনার পিছনে টাকার খেলা আছে। গোটা খেলার পিছনে অদৃশ্য কোনও হাত আছে। তা মুখ্যমন্ত্রীর হতে পারে, স্বাস্থ্য মন্ত্রীর হতে পারে, স্বাস্থ্য সচিবেরও হতে পারেন। আর সিবিআইও হয়ত চায়নি প্রকৃত সত্য সামনে আসুক। ওরাও তদন্ত নষ্ট করেছে।’
আসলে কলকাতা পুলিশের তদন্ত এবং সিবিআই-র কার্যত তাতেই সীলমোহর দেওয়া, অনেক অসঙ্গতি, অসংখ্য উত্তরহীন প্রশ্ন, দায়সারা চার্জশিট – এসবের জন্যই এত ক্ষোভ। এজন্যই মানুষ বলেছেন, সবই দিল্লি-নবান্নের সেটিং বা বোঝাপড়া।
৯ আগস্ট সকালে সেমিনার রুমে অর্ধনগ্ন অবস্থায় পড়ে থাকা পড়ুয়া-চিকিৎসকের দেহ ঘিরে বহিরাগতদের ভিড়ের যে ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছিল, তাকে তদন্তের আওতায় কেন আনেনি সিবিআই? কেন চার্জশিটেও নেই সেই ভিডিও-র প্রসঙ্গ! কাকে বাঁচাতে?
সেই রাতেই কেন অতি সক্রিয়তায় পুলিশ দেহ দখল করে বাবা-মায়ের অনুমতি ছাড়াই সোদপুরের বাড়ি নিয়ে গেল এবং দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের কোনও সুযোগ না রেখেই তৃণমূলের নেতাদের দিয়ে দ্রুত সৎকার করানো হলো কেন? এই ঘটনা কি তথ্য প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা নয়? কেন সিবিআই তদন্তে আসল না? কাদের স্বস্তি দিতে?
আদালতে সিবিআই বিভিন্ন দিনের শুনানিতে লিখিতভাবে জানিয়েছিল, সন্দীপ ঘোষ, অভিজিৎ মণ্ডলের ফোনের কলরেকর্ড থেকে জানা গেছে সেদিন সকালে তারা ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। কেন আদালতে জানালেও চার্জশিটে তার উল্লেখ নেই? আর সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে চার্জশিট তো আজও দেয়নি সিবিআই। কেন, কোন মাথাকে আড়াল করতে? খুন-ধর্ষণের ঘটনাস্থল কী চারতলা, ঘটনার ১৬২ দিন পরেও সিবিআই তা জানায়নি কেন? কেন্দ্রীয় ফরেনসিক ল্যাবরেটরির রিপোর্ট অনুযায়ী চারতলার সেমিনার রুমে ধ্বস্তাধ্বস্তির কোনও চিহ্নই পাওয়া যায়নি। প্রশ্ন, তাহলে ঘটনাস্থল কোথায়, আর আসামি সঞ্জয় রাই একাই একাজ করেছে, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো কীভাবে? একজনকে শাস্তি দিয়ে বাকিদের বাঁচানোর চেষ্টা কার নির্দেশে?
সেই রাতে সিসিটিভি ক্যামেরায় হাসপাতালের চারতলায় যে ৬৮ জনকে সিসিটিভি-তে দেখা গিয়েছিল, তাদের তদন্তের আওতায় আনা হয়েছিল কী? ডিএনএ পরীক্ষায় একাধিক জনের নমুনা পাওয়া সত্ত্বেও সেখানে উপস্থিত সবার ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়নি, কাকে বা কাদের বাঁচাতে? নার্সিং স্টেশনে চব্বিশ ঘণ্টা কর্তব্যরত নার্স, চিকিৎসক, হাসপাতালের কর্মীদের সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে একজন ঢুকল, এই অপরাধ করল আর হেঁটে বেরিয়ে গেল, এটা বিশ্বাসযোগ্য! কিন্তু সিবিআই চার্জশিটে এই অসম্ভবকে সম্ভব করল কাকে বা কাদের স্বস্তি দিতে? সিসিটিভি সংক্রান্ত পুলিশের রিপোর্ট বলছে, অপরাধীর সেমিনার রুমে ঢোকা আর বেরানোর সময়ের ব্যবধান ২৯ মিনিট। মাত্র ২৯ মিনিটের মধ্যে এক নেশাগ্রস্ত ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটিয়ে, রক্ত মুছে, দেহ সাজিয়ে রেখে নিশ্চিন্তে ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে গেল! এটাও কি বিশ্বাসযোগ্য!
হাসপাতাল থেকে বাবা-মাকে প্রথমে আত্মহত্যার কথা জানানো হয়েছিল। পরে জানা যায় প্রকৃত ঘটনা। মেয়ের শেষকৃত্যের আগেই নাকি ডিসি(নর্থ) নগদ টাকা নিয়ে বাড়িতে গিয়েছিল। বাবা-মা’কে কিনে নেওয়ার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিল কে? এসব অভিযোগকে তদন্তের আওতায় আনা হলো না কাদের স্বস্তি দিতে? ৪ নভেম্বর সিবিআই আদালতে জানায়, সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ মিলেছে তাই প্রথম দফার চার্জশিটে নাম যুক্ত হয়েছে। সাথে এটাও জানিয়েছিল, এর অর্থ এটা নয় যে আর কেউ যুক্ত নয়। অথচ সিবিআই ১৩ ডিসেম্বরে ‘যথেষ্ট প্রমাণ’-এর অভাবে আদালতে দ্বিতীয় চার্জশিট দিল না কাদের বাঁচাতে?
কাদের বাঁচাতে এই অসম্পূর্ণ তদন্ত। কাদের স্বস্তি দিতে চাইল দিল্লি-নবান্ন সেটিং? এই সেটিং-এ চাপা পড়ছে রাজ্যের একের পর একের দুর্নীতি। এই সেটিং-এ আর অভয়ার প্রতিবাদকে ধামাচাপা দিতে দেওয়া যাবে না।
Editorial
মাত্র এক দোষীর শাস্তি, স্বস্তি পেল কারা?
×
Comments :0