বিজেপির হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পের আগ্রাসী প্রভাব ক্রমশ প্রকট হচ্ছে ভারতে। আগ্রাসী নয়া উদারবাদী সংস্কারের বহুমুখী আক্রমণ, হিন্দুত্ব-কর্পোরেট জোট শক্তিশালী করে দেশের সম্পদকে মুষ্টিমেয় অংশের হাতে দেওয়া হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে ধ্বংস করে বৈষম্য (inequality)’র বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে ক্ষমতাসীন বিজেপি।
ভারতের সবচেয়ে ধনী মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ। অথচ সেই এক শতাংশের দখলেই রয়েছে দেশের গত এক দশকে (২০১২ থেকে ২০২১) সৃষ্ট সম্পদের ৪০ ভাগ! আর ওপরের ৫ শতাংশকে হিসেবে নিলে দেখা যাচ্ছে তাদের হাতে রয়েছে ৬০ ভাগ সম্পদ।
জিএসটি’র মতো পরোক্ষ কর থেকে আয় বাড়ছে সরকারি কোষগারে। আর্থিক দিক থেকে নিচের দিকের অংশের ওপরেই যে বোঝা বাড়ছে, তার তথ্যও পেশ করেছে এই সমীক্ষা।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ‘অক্সফ্যাম’ (Oxfam) একটি রিপোর্টে ভারতে বাড়তে থাকা আয় বৈষম্যের এমনই এক চিত্র ফুটে উঠেছে।
প্রাপ্ত তথ্য থেকে অক্সফাম জানিয়েছে, ভারতের জনসংখ্যার প্রান্তিক ৫০ শতাংশের কাছে রয়েছে এই সময়েই সৃষ্ট সম্পদের মোট পরিমাণ মাত্র ৩ শতাংশ।
প্রতি বছরই অক্সফাম পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক অবস্থা, আয়-ব্যয় এবং ধনী-দরিদ্র সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা চালায়। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক বৈঠকে (World Economic Forum Annual Meeting)-এ এই সমীক্ষার ফলাফল গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনাও করা হয়।
‘অক্সফ্যাম’ বলেছে যে ভারতের প্রথম দশজন ধনীর ওপর ৫ শতাংশ হারে সম্পদ কর বসালে শিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার জন্য যা টাকা প্রয়োজন তা পাওয়া যাবে।
রিপোর্টে বলা হয় কেবল গৌতম আদানির ওপরেই ৫ শতাংশ কর আরোপ করলে ভারতে প্রায় ৫ লক্ষ শিক্ষক নিয়োগ করা সম্ভব। ‘সার্ভাইভাল অব দ্য রিচেস্ট’ (‘Survival of the Richest’) বা ধনীশ্রেষ্ঠের জয় শিরোনামের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে, ভারতের বিলিওনেয়ারদের যদি তাদের সম্পূর্ণ সম্পদের উপর একবার ২ শতাংশ করে কর ধার্য করা হয় তবে ভারত আগামী তিন বছরের জন্য দেশের অপুষ্টি মেটানোর জন্য ৪০,৪২৩ কোটি টাকার প্রয়োজন মেটাতে পারবে।
লিঙ্গ বৈষম্যের বিষয়ে, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে একজন পুরুষ শ্রমিকের প্রতি ১ টাকার বিপরীতে মহিলা শ্রমিকরা মাত্র ৬৩ পয়সা উপার্জন করেছেন।
তফসিলি জাতি এবং গ্রামীণ কর্মীদের ক্ষেত্রে তফাৎ আরও বেশি- তফসিলিরা ‘সুবিধাপ্রাপ্ত’ সামাজিক গোষ্ঠীগুলির তুলনায় ৫৫ শতাংশ কম উপার্জন করে এবং গ্রামীণ শ্রমজীবীরা ২০১৮ এবং ২০১৯ এর মধ্যে শহুরে শ্রমজীবীর উপার্জনের মাত্র অর্ধেক আয় করেছিল।
অতিমারী শুরু হওয়ার পর থেকে, ভারতে বিলিয়নেয়াররা তাদের সম্পদের ১২১ শতাংশ বা প্রতিদিন প্রকৃত আয় ৩,৬০৮ কোটি টাকার বৃদ্ধি করেছে, অক্সফাম বলেছে।
অন্যদিকে, পণ্য ও পরিষেবা কর (GST)’র মোট ১৪.৮৩ লক্ষ কোটি টাকার প্রায় ৬৪ শতাংশ ২০২১-২২ সালে জনসংখ্যার নিচের ৫০ শতাংশ থেকে এসেছে, জিএসটির মাত্র ৩ শতাংশ এসেছে শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনীর থেকে।
অক্সফাম বলেছে যে ভারতে মোট বিলিওনেয়ারের সংখ্যা ২০২০ সালে ১০২ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ১৬৬ হয়েছে।
ভারতের ১০০ জন ধনীর সম্মিলিত সম্পদ ৬৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (৫৪.১২ লাখ কোটি টাকা) ছুঁয়েছে, যা কিনা এমন একটি পরিমাণ যা ১৮ মাসেরও বেশি সময় ধরে পুরো কেন্দ্রীয় বাজেটে অর্থ যোগাতে পারে, অক্সফাম যোগ করেছে।
অক্সফাম ইন্ডিয়ার সিইও অমিতাভ বেহার বলেছেন, ‘‘দেশের প্রান্তিক- দলিত, আদিবাসী, মুসলিম, মহিলা এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীরা এমন একটি ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে যা সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করে।
সংবাদমাধ্যমে তিনি বলেছেন, ‘‘ধনীদের তুলনায় দরিদ্ররা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং পরিষেবাগুলিতে বেশি ব্যয় করে অসমনুপাতিকভাবে বেশি কর দিচ্ছে। সময় এসেছে ধনীদের কর দেওয়ার এবং তাদের ন্যায্য অংশ দেওয়া নিশ্চিত করার।’’ বেহার কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীকে সম্পদ কর এবং উত্তরাধিকার করের মতো প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য অনুরোধ করেছেন, যা, তাঁর মতে, বৈষম্য মোকাবেলায় ঐতিহাসিকভাবে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
Comments :0