মাছ ভাজা, গোরুর মাংস, মন্দির মসজিদ, এসব উপলক্ষ মাত্র, এগুলো দেখিয়ে মানুষের মধ্যে ভাগ করে রুটি রুজির সমস্যা থেকে দৃষ্টি ঘোরানোই বিজেপি এবং তৃণমূলের আসল লক্ষ্য। মঙ্গলবার কলকাতা জেলা বামফ্রন্টের ডাকা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মিছিল শেষে সিপিআই(এম)-র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম একথা বলেছেন।
গুজরাট নির্বাচনের প্রচারে পরেশ রাওয়ালের বাঙালি বিদ্বেষী মন্তব্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন, আমরা জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলছি, রোজগার নেই কেন জানতে চাইছি, ওরা বলছে, কেন মাছ খাবে? মানুষের দুর্দশাকে চাপা দিতে এটাই দক্ষিণপন্থীদের কৌশল।
এদিন বাবরি মসজিদ ভাঙার বার্ষিকীতে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, ইতিহাস বিকৃতির প্রতিবাদে কলকাতা জেলা বামফ্রন্টের উদ্যোগে পার্কসার্কাস থেকে রাজাবাজার পর্যন্ত একটি মিছিল হয়েছে। ছাত্র-যুব, মহিলা, কর্মচারী সহ শহরের বিভিন্ন অংশের মানুষ এই মিছিলে অংশ নিয়ে সম্প্রীতি রক্ষার আহবান জানিয়ে স্লোগান দিয়েছেন। মন্দির মসজিদের নামে বিভাজনের রাজনীতির বিরোধিতা করেছেন। দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের ওপরে আক্রমণ প্রতিরোধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন। মিছিল আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড হয়ে মৌলালি, শিয়ালদহ পেরিয়ে রাজাবাজারে গিয়ে শেষ হয়েছে।
মিছিলে মহম্মদ সেলিম, বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো সদস্য সূর্য মিশ্র, পার্টির কলকাতা জেলা কমিটির সম্পাদক কল্লোল মজুমদার, পার্টি নেতা রবীন দেব, অনাদি সাহু, সিপিআই নেতা প্রবীর দেব, ফরওয়ার্ড ব্লকের বাংলা কমিটির সম্পাদক নরেন চ্যাটার্জি সহ বামফ্রন্টের শরিক দলগুলির নেতৃবৃন্দ অংশ নেন।
এদিন রাজ্যের বিভিন্ন জায়গাতেই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মসূচী পালিত হয়েছে বামফ্রন্ট এবং বামপন্থী সংগঠনগুলির উদ্যোগে। জেলাগুলিতে মিছিল, সম্প্রীতির জন্য আলোচনা সভা, রক্তদান শিবির ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মিছিল শেষে রাজাবাজার মোড়ে আয়োজিত সভায় সেলিম বলেছেন, আমাদের দেশে ধর্ম, ভাষা, উপাসনা স্থল, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক সব কিছুতে বৈচিত্র্য রয়েছে। এই বৈচিত্রকে উদযাপন করার বদলে তার ওপরে আঘাত হানা হচ্ছে। সংবিধানের কাঠামোকে ভাঙতে চাইছে সঙ্ঘ পরিবার। সঙ্ঘ পরিবার স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধী ছিল, এখন স্বাধীনতা সংগ্রামের ফসলকে নষ্ট করতে চাইছে। মানুষের মধ্যে সম্পর্ককে বিষাক্ত করতে চাইছে। একাজের জন্য আরএসএস নিজের নামে রাজনীতি করে না, বিজেপি’র নামে করে, বাংলায় তৃণমূলের নামে করে। দুর্গাপুজোর সময় মেটিয়াব্রুজকে দাঙ্গাবিধ্বস্ত নোয়াখালির মতো দেখিয়ে সারা দেশে প্রচার করেছে। মমতা ব্যানার্জি তার বিরোধিতা করেন না। বরং তিনি বলেছেন যে আরএসএস খারাপ সেটা তিনি বিশ্বাসই করেন না।
সেলিম বলেন, জিনিসের দাম বেড়েছে তো কি হয়েছে, গুজরাতের নির্বাচনে পরেশ রাওয়াল বিজেপি’র হয়ে প্রচারে বলেছেন, মোদীর কাছ থেকে কম দামে গ্যাস নিয়ে মাছ ভাজাবেন? এরাই আগে গোরু কেন খায় প্রশ্ন তুলেছিল, এখন মাছ কেন খাবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। আসলে প্রশ্ন গোরু কিংবা মাছের নয়। দক্ষিণপন্থার কৌশলই হলো মূল্যবৃদ্ধির কথা উঠলে ওরা সেটা চাপা দিতে ধর্মের কথা বলবে। অযোধ্যার পরে তাই একের পর এক ধর্মস্থানের নাম করে মন্দিরের কথা বলছে। আমাদের দেশের সব ধর্মের মানুষের একসঙ্গে থাকার ইতিহাস ভোলাতে চাইছে। আমরা মমতা জমানায়, মোদী জমানায় মানুষের দুর্দশা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি। ওরা এখন আকবর বাবরের জমানায় আমাদের পিছিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। মূল্যবৃদ্ধি, চাকরি বিক্রির থেকে নজর ঘোরাতে চাইছে ধর্মের নামে।
তিনি বলেন, কেন বাঙালির বিরুদ্ধে ঘৃণা জাগাতে হচ্ছে? বাঙালি মানেই রোহিঙ্গা! দেশের মানুষের মনে এভাবে ভয় জাগানো হচ্ছে বাঙালিদের নামে। এভাবে দুর্নাম ছড়িয়ে তারপরে আক্রমণ নামানো হয়, কুকুরকে পাগলা বলে পিটিয়ে এভাবেই মারে। মোদীও ইঙ্গিত করেছিলেন, লুঙ্গি দেখে বাংলাদেশী চেনার। নিজের ইচ্ছে মতো খাওয়ার, ইচ্ছেমতো পোশাক পরা আমাদের বুনিয়াদী অধিকার। ওরা বৈচিত্র্য ভেঙে সবার ওপর এক সংস্কৃতি চাপাতে চাইছে। মোদীও সবার এক ইউনিফর্ম চাইছে, মমতাও সব স্কুলে এক ইউনিফর্ম চাইছে। বিজেপি’র সঙ্গে হাত মিলিয়ে মমতা ব্যানার্জিও উত্তরবঙ্গকে আলাদা করতে চাইছেন। এই মাটিতে সবার রক্ত রয়েছে, দেশের জন্য সব অংশের মানুষ রক্ত দিয়েছে, সবার হক আছে। দেশ কারো বাপের নয়। মমতা ব্যানার্জিকে সামনে রেখে গত বারো বছর ধরে এরাজ্যে তৃণমূলের পর্দার আড়ালে বিজেপি’র মঞ্চ তৈরি করা হচ্ছে। এখন যাকে বিরোধী দল বলে দেখানো হচ্ছে তারা ফেক বিরোধী। রাজ্যে বিজেপি ফেক বিরোধী, কেন্দ্রে তৃণমূল ফেক বিরোধী। ওদের দল বদলানো দেখুন, ওদের মধ্যে কোনও ঝগড়াই নেই। কিন্তু ওরা মানুষের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম, বাংলাভাষী-হিন্দিভাষী প্রশ্ন তুলে ভাগ করে দিচ্ছে।
রাজাবাজার মোড়ের সভায় এছাড়াও ভাষণ দেন বিকাশ ঝা, ওয়াজেদ হোসেন, আরশাদ আলি প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভা পরিচালনা করেন ইজাজ আহমেদ। সভায় কল্লোল মজুমদার সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ঐক্যর সম্প্রীতির এই মিছিলে ব্যাপক সংখ্যায় অংশগ্রহণ করার জন্য মানুষকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
Comments :0