সশস্ত্র হামলা তো আছেই। গাঁজা কেস, পানি কেসও কম নেই। লালঝান্ডা কাঁধে নিলেই কোনও না কোনও ব্যবস্থা। উত্তর দিনাজপুরের বুথে বুথে সরবে হয়েছে পদযাত্রা।
জেলার সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দের বক্তব্য, জেলার ১৫৯৮টি বুথ। বুথে বুথে মিছিলে গ্রামের মানুষকে সাহস জোগানো গিয়েছে। সব থেকে বড় প্রমাণ চোপড়া ব্লক।
চোপড়ার ঝিরনিগাও পঞ্চায়েতের বাসিন্দা ষাটোর্ধ সায়েরা খাতুন। হতদরিদ্র বৃদ্ধা। প্রধানমন্ত্রী আবাসের জন্য উপযুক্ত হলেও পঞ্চায়েত কিংবা ব্লক থেকে মেলেনি ছিটেফোঁটা সাহায্য। এতদিন এই মানুষগুলির অস্তিত্বকেই বাইরে আসতে দেয়নি তৃণমূলের গ্রামীণ বাহুবলীরা। কিন্তু এবার সায়রা খাতুন নিজে গিয়েছেন ব্লক অফিসে। চাপের মুখে প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছে, তাঁর বাড়ির ব্যবস্থা করা হবে।
রাজ্যের বহু ব্লকে গত ১০ বছর ধরে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে কার্যত নিঙড়ে ছিবড়ে করে দিয়েছে তৃণমূল। গরিবের প্রাণের ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত পরিণত হয়েছে তৃণমূলী মেশিনারির ‘করে খাওয়ার যন্ত্রে’। সমস্ত সরকারি প্রকল্পের মতো প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনাতেও হয়েছে দেদার লুঠ। এতদিন বঞ্চিত হলেও প্রকৃত উপভোক্তারা আওয়াজ তুলতে পারেননি।
কিন্তু নভেম্বরের গোড়া থেকে গ্রামে গ্রামে লালঝান্ডা উড়তে শুরু করায় আমূল বদলেছে পরিস্থিতি। তার ফলেই লালমাটি থেকে শুরু করে তরাই ডুয়ার্সের জনপদ- ব্লকে ব্লকে আছড়ে পড়তে শুরু করেছে ক্ষোভের বিস্ফোরণ। যে ক্ষোভ সামলাতেই দিদির সুরক্ষা কবচের আশ্রয় নিতে হচ্ছে গোটা তৃণমূল দলকে।
পাহাড় এবং সমতলের মধ্যে সেতুর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে উত্তর দিনাজপুর জেলা। এই জেলার চিকেন্স নেকের ভৌগলিক গুরুত্বও অপরিসীম। উত্তর দিনাজপুরের চোপড়া, গোয়ালপোখর, চাকুলিয়ার মতো ব্লকগুলিকে কার্যত বদ্ধভূমিতে পরিণত করেছে তৃণমূল। ২০১৯ সালে উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ লোকসভা কেন্দ্রের বামফ্রন্ট প্রার্থী ছিলেন মহম্মদ সেলিম। তাঁর প্রচারে অংশ নেওয়া গ্রামবাসীদের শায়েস্তা করার জন্য গোয়ালপোখর, চাকুলিয়ার গ্রামে গ্রামে তান্ডব চালিয়েছিল পুলিশ। হাতিয়ার সেই মিথ্যা অভিযোগ। যার নাম কখনও গাঁজা কেস, আবার কখনও পানি (পড়ুন অবৈধ কাফসিরাপ) কেস। চোপড়া বিধানসভা কেন্দ্রের বহু এলাকাকে পরিণত করা হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্রের গুদামঘরে। এই অঞ্চলের অর্থনীতির অন্যতম মেরুদন্ড চা বাগান। ‘বেয়াড়া’দের শায়েস্তা করতে খুন জখমের পাশাপাশি চা বাগানের গাছও অবাধে লুঠ করেছে তৃণমূল।
রায়গঞ্জ শহরে লাগোয়া কুমারজোল গ্রামের ইব্রাহিম সেখের কথায়। দুই ছেলে ওয়েহ আলি এবং আসিল মহম্মদ একশো শতাংশ দৃষ্টিহীন। মাথার উপর আচ্ছাদন নেই। তারপরেও মেলেনি আবাসের ঘর। কিংবা ধরা যাক কুমারবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা ফৈজুল হক, চাকুয়া মহম্মদ, টারুয়া মহম্মদ, বাজেদুর সেখের কথা। তাঁদের অভিযোগ, হাই স্কুলের কেরানি, রেশন ডিলার, তৃণমুলের তাবড় তাবড় নেতাদের পরিবারে একাধিক সদস্যের নাম আছে আবাসের তালিকায়। আগেও টাকা পেয়েছে। কিন্তু যাঁদের সাহায্য সত্যিই প্রয়োজন তাঁদের কানাকড়িও জোটেনি।
রায়গঞ্জ ব্লকের বাহিন গ্রাম পঞ্চায়েতের বিভিন্ন গ্রামের চিত্র প্রায় একই। প্রধানের, উপ প্রধানের বাড়ির গোয়ালঘর তৈরির জন্যে আবাস যোজনায় নাম উঠেছে। গ্রামের মানুষের অভিযোগ, তৃণমূলের তাবর নেতা আইনুল জাফর, দুলুরা নামে বেনামে একাধিকবার টাকা তুলে হজম করলেও ২০১৭ সালের বন্যায় ঘর হারানো মানুষ কোনও ক্রমে গরু ছাগলের সঙ্গে শয্যা ভাগ করে নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। বানের জল তাঁদের মূলিবাঁশের ঘর কেড়েছে। তৃণমূলের সমিতি একটা ত্রিপল দিয়েও সাহায্য করেনি।
এতদিন এই নামগুলিই গ্রামের বাইরে আসতে পারত না, সাহায্য পাওয়া দূরের কথা। তৃণমূলের অঙ্গুলি হেলনে চলা ব্লক প্রশাসনগুলি ন্যূনতম সাহায্য করার প্রয়োজন বোধ করেনি।
কিন্তু ব্লকে ব্লকে বামপন্থীদের গণজমায়েত শোষণের ভারসাম্যে আঘাত দিচ্ছে। বহু ক্ষেত্রেই নিমরাজি হয়েও প্রকৃত উপভোক্তাদের তালিকায় সই করতে বাধ্য হচ্ছেন প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা। গ্রামে গ্রামে তৃণমূলকে বলতে শোনা যাচ্ছে, এবারের পঞ্চায়েত মনে হয় না খুব সহজ হবে।
Comments :0