Editorial 20 January

দখলদারির লক্ষ্য বিচার ব্যবস্থা

সম্পাদকীয় বিভাগ

দখলদারি ও আধিপত্য যাদের রাজনীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য তারা মুখে যতই গণতন্ত্রের কথা বলুক আসলে গণতান্ত্রিক ধ্যান ধারণার সঙ্গে তাদের চিন্তা চেতনার কোনও সম্পর্ক নেই। তারা আগ্রাসী দখলদারির রাজনীতিতেই বিশ্বাসী। রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে আধিপত্য কায়েম করে সর্বময় কর্তৃত্ব হাতে নিতে চায়। হিন্দুত্ববাদের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদকে আঁকড়ে ধরে গণতন্ত্রকে বর্জন করতে চায়। ফ্যাসিবাদেরই এটা একটা রূপ। ফ্যাসিবাদের প্রায় সব বৈশিষ্ট্যই এদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন বা প্রকটভাবে বিরাজমান।
নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর শাসক আরএসএস-বিজেপি এই দখলদারিকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। দখলদারিত্ব কায়েম করতে গিয়ে পদে পদে পদদলিত হচ্ছে সংবিধান। নির্মম ও নির্লজ্জভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছে ভারত ভাবনা ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মৌলিক অনুসঙ্গগুলি। আরএসএস-বিজেপি চায় প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ যেগুলি সরকারের প্রশাসনিক নির্দেশে পরিচালিত হয় না, সংবিধানের বিধিবদ্ধ নিয়মে স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হয় সেইসব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলিকে পুরোপুরি কবজা করতে। বিজার্ভ ব্যাঙ্ক, নির্বাচন কমিশন, সিএজি ইত্যাদি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলি স্বশাসিত সংস্থা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এখানে সরকার বা শাসক দলের কোনোরকম হস্তক্ষেপ বা প্রভাব চলে না। কিন্তু আরএসএস-বিজেপি এহেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তুষ্ট নয়। তারা চায় এই প্রতিষ্ঠানগুলিও তাদের মর্জিমাফিক চলুক। তাদের পছন্দ মতো এবং প্রত্যাশা মতো কাজ করুক। তার জন্য জরুজি দখলদারি। কীভাবে দখল করা হবে? যতদিন সংবিধান বদলে তাদের নিজেদের মতো করে করা যাচ্ছে ততদিন বিজেপি চায় এইসব প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে তাদের মতাদর্শে বিশ্বাসী তথা আরএসএস অনুগামীদের নিয়োগ করতে।


২০১৪ সালের পর থেকে নানা ছলাকলায় এবং নানা কৌশলে বিজেপি এই প্রয়াসই চালিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ, আধা সামরিক বাহিনী থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনীকে দখলের অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। একাজে যে তারা অনেকটাই সফল সন্দেহ নেই। মোদী জমানায় নিযুক্ত সামরিক শীর্ষ কর্তাদের ভাষ্য থেকেই এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। শিক্ষা ক্ষেত্রকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলেছে হিন্দুত্ববাদী অন্ধত্ব। যুক্তিহীন, অবাস্তব চিন্তার আরএসএস অনুগামীরাই এখন শিক্ষার যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদগুলি দখল করে আছেন। গবেষণা সংস্থার শীর্ষে আছেন একজন ধর্মান্ধ কল্পনাবিলাসী ব্যক্তি। বিজ্ঞান তার গরিমা হারিয়ে হিন্দুত্ববাদী কল্পবিজ্ঞানের রূপ নিয়েছে। চিরকাল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অর্থনীতিবিদরা চালাতেন। সরকার নিরপেক্ষভাবে। মোদী ক্ষমতায় আসার পর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে সংঘাত বাধে সরকারের। বি‍‌শেষ করে নোট বাতিলের সময় স্পষ্ট হয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উপর সরকারের কর্তৃত্ব। পরে ঋণনীতি নির্ধারণে সংঘাত চলতে থাকায় সরকারি চাপে গঠন হয় ঋণনীতি কমিটি। তাতে সরকারি প্রতিনিধি রেখে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উপর ছড়ি ঘোরানো শুরু হয়। সর্বশেষে গভর্নর করা হয় মোদী অনুগত এক আমলাকে। এখন বকলমে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক চালায় সরকারই। নির্বাচন কমিশন, সিএজি সহ সর্বত্র একই কায়দায় শীর্ষ পদে নিয়োগ করা হচ্ছে আরএসএস সমর্থকদের যাতে সরকারের প্রত্যাশা অনুযায়ী তারা চলে।


রাষ্ট্রের বাকি সবক্ষেত্রে মোটামুটি দখলদারি কায়েম হলেও বিচার ব্যবস্থায় পুরোপুরি দখলদারি সম্ভব হয়নি। শীর্ষ ও সবেরাচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে বর্তমান ব্যবস্থায় নাক গলানোর সুযোগ নেই সরকারের। তাই এই ব্যবস্থাটাকেই বাতিল করে বিচারপতি নিয়োগে সরকারি কর্তৃত্ব কায়ম করতে সরকার মরিয়া হয়ে উঠেছে। মোদী ক্ষমতায় এসে প্রথম বছরেই কলেজিয়াম পদ্ধতি বাতিল করে সরকার প্রভাবিত জুডিসিয়াল কমিশন আইন তৈরি করেন। কিন্তু তাকে সংবিধানবিরোধী বলে বাতিল করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। তার পর থেকে কলেজিয়াম পদ্ধতির বিরুদ্ধে লাগাতার আক্রমণ করে চলেছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থেকে শুরু করে শাসক দলের নেতারা। তাতে যোগ দেয় লোকসভার অধ্যক্ষ, উপরাষ্ট্রপতিও। সর্বশেষ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দিয়ে কলেজিয়ামের বদলে সরকারি প্রতিনিধি নিয়ে নতুন নিয়োগ কমিটি গঠন করতে বলেছেন। বিচারব্যবস্থাকে দখল করতে তারা যে কতটা মরিয়া এটা তারই প্রমাণ।

Comments :0

Login to leave a comment