এই প্রশ্নে দ্বিমত পোষণের কোনো সুযোগ নেই যে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য কোনো দেশের নাক গলানো উচিত নয়। তেমনি কোনো ভারতীয় নাগরিক বিদেশে গিয়ে দেশের মান মর্যাদা হানিকর মন্তব্য করবেন সেটাও গ্রহণযোগ্য নয়। তার অর্থ আবার এটাও হতে পারে না যে কোনো নাগরিক দেশের বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারবে না।
এক্ষেত্রে অবশ্যই একটা ভারসাম্য রক্ষা করতে হয় যাতে কোনো অবস্থাতেই দেশের সম্মানহানি না হয় আবার নাগরিকের বাক্ স্বাধীনতাও বজায় থাকে। প্রশ্নটা উঠেছে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর বিদেশে করা একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে। লন্ডনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে রাহুল গান্ধী ভারতের গণতন্ত্রের বর্তমান বিপদ নিয়ে কিছু কথা বলেছিলেন।
মোদী জমানায় ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্র বিপজ্জনক ঝুঁকির মধ্যে। সংসদে বিরোধী পক্ষের অধিকার কম সঙ্কুচিত। কার্যত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বিরোধীদের কার্যত পাত্তাই দেওয়া হয় না। কথা বলা, দাবি করা, আলোচনা করা, বিরোধিতা করা সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধীদের প্রধান কাজ।
সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধীদের সেই পরিসর দিতে হয়। কিন্তু মোদী সরকার সেটা মানতে রাজি নয়। বিরোধীদের পদে পদে অগ্রাহ্য করাই মোদী সরকারের নীতি। বিরোধী নেতাদের পদে পদে হয়রানি, কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাকে ব্যবহারে বিরোধীদের নিষ্ক্রিয় ও দমিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। বিরোধী তৎপরতা ও বিরোধী কণ্ঠ অবরুদ্ধ করাই একমাত্র লক্ষ্য।
এই জমানায় পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। কাশ্মীর তো বটেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নানাভাবে নির্যাতন, আক্রমণ, দলবদ্ধ হামলার ঘটনা সারা দেশেই নিত্য ঘটে চলেছে। বিদ্বেষ ও ঘৃণা ভাষণ চলছে অহরহ। করছে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরাই। পুলিশ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয় না। পরোক্ষে সমর্থন। সরকারের সমালোচনা করলেই রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ে হিন্দুত্ব বাহিনী। অর্থাৎ মোদীর ভারতে মোদী বা মোদী সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না।
স্বাধীনভাবে কথা বলার, মত প্রকাশের, সমালোচনা করার, বিরোধিতা করার সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার বিপন্ন।
মোদী সরকারের আমলে ভারতের গণতন্ত্র, মানবাধিকার এমন নির্মম বাস্তবই খানিক ফুটে উঠেছে রাহুল গান্ধীর লন্ডনের বক্তৃতায়। এই সত্য শুধু ভারতের জনগণ উপলব্ধি করছেন তা নয়, গোটা দুনিয়া সেটা পর্যবেক্ষণ করছে। আমেরিকা-ইউরোপের বিখ্যাত সংবাদমাধ্যমগুলিতে ভারতীয় গণতন্ত্রের এমন উদ্বেগজনক ছবি প্রায়সই ধরা পড়ে।
ভারতে জনগণ যেমন অন্যান্য দেশে ভাল-মন্দ যাই ঘটুক জানতে পারেন তেমনি বিদেশিরাও ভারতে সবটাই জানেন। তারজন্য রাহুল গান্ধী বা অন্য কোনো বিরোধী নেতাকে বিদেশে গিয়ে বক্তৃতা দেবার প্রয়োজন হয় না। আমেরিকার সরকারি রিপোর্টে প্রায় প্রতি বছরই ভারতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, বাক্ স্বাধীনতায় রাশ টানা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়ানো ইত্যাদি নিয়ে উল্লেখ থাকে। তাছাড়া, ব্যক্তি স্বাধীনতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ইত্যাদি উদার গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার সংক্রান্ত মাপকাঠিকে সাম্প্রতিককালের ভারতের দ্রুত অবনমন ঘটছে।
সম্প্রতি একটি সাধারণ মানহানির মামলায় রাহুল গান্ধীর দু’বছর জেল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সাংসদ পদ খাজির ও সরকারি আবাসন থেকে উৎখাতের নোটিসকে কেন্দ্র করে যে তুমুল বিতর্ক দেশে শুরু হয়েছে তার ঢেউ আছড়ে পড়েছে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের সব দেশে। মার্কিন বিদেশ দপ্তরের মুখপাত্র গণতন্ত্রে বাক্ স্বধীনতার কথা স্মরণ করিয়ে বলেছে তারা রাহুল গান্ধীর মামলার উপর নজর রাখছে।
একইভাবে মুখ খুলেছে জার্মানির বিদেশ দপ্তরও। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বজায় থাকবে এমন প্রত্যাশা করেছে জার্মানি। বোঝাই যাচ্ছে যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশই ভারতে বর্তমান গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিয়ে খোঁজ খবর রাখছে। গণতন্ত্রে বিশ্বাসীরা গণতন্ত্র শিথিল হলে উদ্বিগ্ন হবে এটাই স্বাভাবিক। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে ঢাক পিটিয়ে নৃত্য করলে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে না। গণতন্ত্র নিয়ে চর্চা করতে হয়, অনুসরণ করতে হয়, বাস্তবে প্রয়োগ করতে হয়।
Comments :0