মার্চের গোড়ায় ব্রিটেনের সংসদে শরণার্থী এবং অভিবাসী বিরোধী বিল পেশ করেন সেদেশের ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক। সেই বিল অনুযায়ী, ‘বেআইনি’ ভাবে ছোট নৌকা করে ব্রিটেনে প্রবেশ করলেই ঠাঁই হবে জেলে। কোনওরকম আইনি প্রতিকার ছাড়াই পত্রপাঠ নিজের দেশে ফেরত পাঠানো হবে শরণার্থীদের। তাঁদের নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানো নিরাপদ না হলে পাঠানো হবে রোয়ান্ডার মতো নিরপেক্ষ কোনও দেশে।
সেই বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হয় ব্রিটেনের নাগরিক সমাজ। সরব হন ইংল্যান্ডের জাতীয় দলের প্রাক্তন স্ট্রাইকার গ্যারি লিনেকার। নিজের টুইটার হ্যান্ডেল থেকে এই বিলের বিরুদ্ধে একরাশ ক্ষোভ এবং ঘৃণা উগড়ে দেন লিনেকার। তিনি লেখেন, ‘‘ব্রিটেনের সাম্প্রতিক অবস্থান ১৯৩০’র দশকের জার্মানিকে মনে করাচ্ছে।’’ তিনি কার্যত হিটলার প্রশাসনের সঙ্গে তুলনা টানেন সুনক প্রশাসনের।
কিন্তু নিজের মত প্রকাশের ‘অপরাধে’ চাকরি খোয়াতে হয় লিনেকারকে। বাক-স্বাধীনতা নিয়ে বড়াই করা ব্রিটেনে সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করায় বিবিসি’র জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘ম্যাচ অফ দ্যা ডে’ সঞ্চালনার দায়িত্ব থেকে সরানো হয় লিনেকারকে।
লিনেকারের অপসারণ যেন আগুনে ঘি পড়ে। উত্তাল হয়ে ওঠে লন্ডন থেকে শুরু করে গোটা দ্বীপরাষ্ট্র। লিনেকারের লড়াইকে সংহতি জানান ব্রিটেনের প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন। ব্রিটেনের বামপন্থীরা পথে নেমে সরকারি স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদে সরব হন।
এই অবস্থায় পিছু হঠতে বাধ্য হয় ঋষি সুনকের দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল সরকার। পরিস্থিতির চাপে সুনক নিজে বাধ্য হন বিবৃতি জারি করতে। ঢোক গিলে তিনি বলেন, লিনেকারের বিষয়টি নিয়ে আরও বিস্তারিত ভাবনা চিন্তা করা প্রয়োজন ছিল বিবিসি’র। আশা করা যায়, আলোচনার মাধ্যমে বরফ গলবে।
বিবিসি বা ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কোম্পানি এদেশের প্রসার ভারতীর মতোই সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা। তাই সুনকের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, জনমতের চাপেই সরকার পিছু হঠছে।
১৪ মার্চ থেকে লিনেকারকে ‘ম্যাচ অফ দ্যা ডে’র হটসিট ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয় বিবিসি। জনমতের চাপে বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়।
যদিও এই গোটা ঘটনাকে কেবলমাত্র লিনেকার ইস্যুতেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছেন না জেরেমি করবিন। সংবাদ সংস্থা এলবিসি’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘টুইটের মাধ্যমে নিজের মূল্যবোধের পরিচয় দিয়েছেন লিনেকার। কিন্তু মূল ইস্যু কোনওভাবেই তাঁর অপসারণ নয়। বরং মূল ইস্যু হল সরকারের আনা জঘন্য একটা আইন, যা কোনও ভাবেই সভ্য সমাজে বরদাস্ত করা যায় না। তাই লিনেকারের প্রতি সংহতি জানিয়েই বলছি, মূল ইস্যু থেকে নজর ঘোরালে চলবে না। এই বিলের আইনে পরিণত হওয়া আটকাতে হবে।’’
ব্রিটেনের বিরোধী শিবির, বিশেষ করে লেবার পার্টির নেতৃবৃন্দ বলছেন, এই বিল মূলত আলবেনিয়া এবং আফ্রিকা থেকে আসা শরণার্থীদের নিশানা করছে। বাঁচার আশায় আফ্রিকার যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশগুলি থেকে পরিবার নিয়ে ইউরোপের দিকে ছুটছে শরণার্থী মানুষের ঢল। প্রাথমিক ভাবে ইউরোপের দেশগুলি তাঁদের আশ্রয়ও দিচ্ছিল। কিন্তু গত ৫-৬ বছর ধরে ইউরোপের একের পর এক দেশে মাথাচাড়া দিচ্ছে উগ্র দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি। নতুন করে মাথাচাড়া দিচ্ছে ফ্যাসিবাদী সংগঠনও। এই আবহে তাঁদের তরফে শরণার্থী বিরোধী জিগির তোলা শুরু হয়।
ইউরোপের সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, দেশে দেশে উগ্র-দক্ষিণপন্থী জিগির উঠতে শুরু করলেও, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত দেশগুলিকে প্রতিবছর নির্দিষ্ট পরিমাণে শরণার্থীদের আশ্রয় দিতেই হয়। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ফলে ব্রিটেনের সেই বাধ্যবাধকতা নেই। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েই শরণার্থী এবং মানবতা বিরোধী আইন পাস করাতে চাইছে ঋষি সুনক সরকার। সম্প্রতি ব্রিটেনে একাধিক হামলা হয়েছে শরণার্থীদের ওপর। আবার হামলার প্রতিবাদও হয়েছে।
কনজারভেটিভ সরকারের দাবি, ছোট ছোট নৌকায় করে আফ্রিকা এবং আলবেনিয়া থেকে শরণার্থীরা ব্রিটেনে প্রবেশ করছে। তাঁদের আশ্রয় দিতে গিয়ে চাপ বাড়ছে দেশের অর্থনীতির উপরে। দক্ষিণপন্থীদের দাবি, শরনার্থীদের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় আনতে গিয়ে ব্রিটিশ সমাজের দুর্বলতর অংশকে সুরক্ষা দেওয়া যাচ্ছে না। একইসঙ্গে সামাজিক ভারসাম্য টলে যাচ্ছে বিপুল সংখ্যক শরনার্থী ব্রিটেনে পা দেওয়ায়। তাই ছোট নৌকায় করে অবৈধ অনুপ্রবেশে পুরোপুরি রাশ টানা হবে।
যদিও সরকারের এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে অন্য কারণ খুঁজে পাচ্ছেন বিরোধীরা। ১৩ মার্চ ‘পলিটিকো’র করা জনমত সমীক্ষা জানায় কনজারভেটিভ পার্টির তুলনায় ২০ শতাংশ ভোটে এগিয়ে রয়েছেন লেবাররা।এই অবস্থায় নিজেদের গদি বাঁচাতে সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের সমর্থন নিশ্চিত করতে চাইছেন ঋষি সুনক। তাই শরণার্থী বিরোধী জিগির তোলা হচ্ছে সরকারি ভাবে।
যদিও কেবল ব্রিটেনেই নয়, ইতালিতেও শরণার্থী বিরোধী আইন পাস হয়েছে। ইতালির সরকার যদিও ঘোষিত মুসোলিনি পন্থীদের হাতে। সেখানেও সমাজের শত্রু হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা কিংবা যুদ্ধে সর্বস্বান্ত হয়েও নতুন ভাবে বাঁচতে চাওয়া মানুষকে।
তবে লিনেকারের প্রতিবাদ আর তাঁর পাশে জড়ো হওয়া মানুষ দেখাচ্ছে বিদ্বেষই শেষ কথা সবসময় বলবে না।
Comments :0