PRIMARY TET SCAM WEST BENGAL

‘ঢাকি সমেত বিসর্জন দিয়ে দেব’: কড়া হুঁশিয়ারি হাইকোর্টের

রাজ্য কলকাতা

teacher recruitment scam west bengal kolkata high court

‘আমি ঢাকি সমেত বিসর্জন দিয়ে দেব’— প্রাথমিকে ভুয়ো নিয়োগ সংক্রান্ত মামলায় মন্তব্য বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের। শুধু তাই নয়, ক্ষুব্ধ বিচারপতি এবার টেট নিয়োগ দুর্নীতিতে কড়া পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়ে প্রয়োজনে প্রাইমারি টেট শিক্ষক নিয়োগের ৪২হাজার ৫০০জনের গোটা প্যানেলই বাতিল করার হুঁশিয়ারি দিলেন।


শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ দুর্নীতিতে এরাজ্যে যা ঘটেছে তা গোটা দেশেই বেনজির বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। প্রাথমিক থেকে এসএসসি, গ্রুপ-সি, গ্রুপ-ডি গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েই একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ। টাকার বিনিময়ে অযোগ্যদের চাকরি দেওয়া শুধু নয়, খালি খাতা জমা দিয়েও টেট পাশ করে গেছেন অযোগ্যরা, অকৃতকার্যরা পেয়ে গেছেন নিয়োগপত্র, আদালত কক্ষেই জমা পড়ছে ভুরি ভুরি অভিযোগ। 

প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী থেকে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি, এসএসএসি’র প্রাক্তন চেয়ারম্যান থেকে সচিব, নজরদারি কমিটির প্রাক্তন উপদেষ্টা থেকে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি— নিয়োগ দুর্নীতি, টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার অভিযোগেই আপাতত জেলে। স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গে এই দৃশ্য আগে কোনোদিনও দেখা যায়নি।


এবার সেই ভুয়ো নিয়োগ মামলাতেই কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য রীতিমতো তাৎপর্যপূর্ণ। ‘আমি ঢাকি সমেত বিসর্জন দিয়ে দেব’। নিয়োগ দুর্নীতিতে তাহলে ঢাকি কে? নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে এমন কোন্‌ মাথা আছে যা এখনও তদন্ত প্রক্রিয়ার বাইরে রয়েছেন? স্বাভাবিকভাবেই উঠছে প্রশ্ন।
মঙ্গলবার আদালতে সেই ভুয়ো নিয়োগ সংক্রান্ত মামলা চলাকালীন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদকে কার্যত হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘যে দিন ২০১৪-র প্রাথমিক টেটের ভিত্তিতে গড়া ২০১৬-র পুরো প্যানেল বাতিল করব সেদিন বলব ঢাকি সমেত বিসর্জনের অর্থ কী।’ ২০১৬’র প্যানেলেই ৪২ হাজার ৫০০ জন প্রাথমিকে চাকরি পেয়েছিলেন।


২০১৪ টেট, নিয়োগ ২০১৬-তে। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ জানিয়েছে সে সময় নিয়োগ হয়েছিল ৪২হাজার ৫০০জন শিক্ষক। এই নিয়োগের আগাগোড়া দুর্নীতি হয়েছে। ১৪০জন প্রার্থী আদালতে মামলা করে অভিযোগ করেছেন, তাঁদের মেধা তালিকায় নাম থাকা সত্বেও তাঁরা ইন্টারভিউতে ডাক পাননি। এমনকি বহু তদবির করে তৎকালীন পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের কাছে পৌঁছাতে পারেননি। 

অভিযোগে তাঁরা বলেছেন ২০১৬-তে যে নিয়োগ হয়েছে তার মধ্যে ৩২ হাজার অপ্রশিক্ষিত প্রার্থী রয়েছেন। এই প্রার্থীদের মধ্যে থেকে এখনও পর্যন্ত যে তথ্য হাতে এসেছে তা বিস্ময়কর। মেধা তালিকায় নেই এমন প্রার্থীরা যেমন নিয়োগপত্র পেয়েছেন তেমন পরীক্ষায় বসেননি পরে নাম অন্তর্ভুক্ত করে প্যানেলে ঢুকেছেন।
আদালতের মন্তব্য, প্রাক্তন সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের আমলে কীভাবে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে তা আর অজানা নেই। এদিন সওয়াল চলাকালীন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘মানিক ভট্টাচার্য পর্যন্ত পৌঁছনোর ক্ষমতা নেই বলে কি চাকরি পাননি মামলাকারীরা?’


আদালত মামলাকারীদের আরও কিছু নথি জমা করার কথা বলেছেন। আদালত আগামী ১০ দিনের মধ্যে এই মামলার ফয়সালা করতে চায়। মামলাটি আগামী ১৬ডিসেম্বর পুনরায় শুনানির জন্য রেখেছে। ২০১৪ টেটের নিয়োগে দুর্নীতি নিয়ে অনেক তথ্যই প্রকাশ্যে এসেছে। তবে অপ্রশিক্ষিত নিয়োগের ব্যাপারে ১৪০ জনের আবেদন গুরুত্ব দিয়ে বিচার হবে বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন।


২০১৪-র টেট উত্তীর্ণ প্রায় ৬০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের মেধা তালিকা জমা দেবার নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট গত ২৩ সেপ্টেম্বর। সেখানেও ছিল অসঙ্গতি। এর আগে ২০১৪ সালের টেটে দু’দফায় শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছেন এমন সমস্ত প্রার্থীদের মেধা তালিকা প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদকে আদালত চেয়ে পাঠিয়েছিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, আদালতের নির্দেশে ছিল, এই শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, তাঁরা লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষায় কত নম্বর পেয়েছেন, সেই নম্বর সহ মেধা তালিকা ৩০ নভেম্বরের মধ্যে আদালতে জমা দিতে হবে। 

২০১৪ সালে টেট বিজ্ঞপ্তি জারি হবার পর প্রায় ২৩লক্ষ প্রার্থী আবেদন করেছিলেন। এঁদের মধ্যে পরীক্ষা দিয়েছিলেন ২১লক্ষ। এই বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থীর মধ্যে শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছেন ৬০ হাজার প্রার্থী। এখন বহু প্রার্থী রয়েছেন যাঁরা যোগ্যতা থাকা সত্বেও চাকরি পাননি। প্রাথমিক টেটের পরীক্ষার্থীদের বক্তব্য, কতজন পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন তা কেন জানানো হলো না? কতজন ৬০শতাংশের বেশি নম্বর পেল তা পর্ষদের অজানা নয়। তাহলে কেন পাশের সংখ্যা গোপন রাখা হয়েছিল? তাছাড়া মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে কতজনের প্রশিক্ষণ রয়েছে, কতজন অপ্রশিক্ষিত পরীক্ষার্থী, তা জানানো হয়নি কেন? ৬০শতাংশের বেশি নম্বর পাওয়া পরীক্ষার্থীর মধ্যে কতজনের প্রশিক্ষণ রয়েছে, কতজনের নেই, তাও গোপন করেছে প্রাথমিক শিক্ষাপর্ষদ।


এদিকে নিয়োগ দুর্নীতিতে  প্রাথমকি শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে সম্ভবত আগামীকালই ব্যাঙ্কশাল কোর্টে ইডি’র বিশেষ এজলাসে চার্জশিট দিতে চলেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। এখন দেখার সেই চার্জশিটে ‘ঢাকি’-র সন্ধান মেলে কি না ? এর আগে আদালতে ইডি’র তরফে জানানো হয়েছিল ২০১৪ সালের প্রাইমারি টেটে ৩২৫জন অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীকে টাকার বিনিময়ে পাশ করিয়েছিলেন মানিক ভট্টাচার্য। তদন্তে সামনে এসেছে এই অবৈধ নিয়োগের মাধ্যমেই মানিক ভট্টাচার্য ৩কোটি ২৫লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন!

 

Comments :0

Login to leave a comment