বিচারপতি নিয়োগে সরাসরি নিয়ন্ত্রণে এবারে কলেজিয়ামে সরকারের প্রতিনিধি রাখতে চাইছে মোদী সরকার। বর্তমানে বিচারপতিদের নিয়ে যে কলেজিয়াম কমিটি রয়েছে তাতে বিচারপতিদের সঙ্গে সরকারি প্রতিনিধিদের রাখা উচিত বলে জানাচ্ছেন খোদ আইন মন্ত্রী কিরণ রিজিজু। এই প্রস্তাব জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়কে চিঠি দিয়েছেন মন্ত্রী রিজিজু।
কলেজিয়াম পদ্ধতিতে নিয়োগে কেন্দ্রের ঢিলেমি নিয়ে মামলার শুনানিতে গত ৬জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রের তীব্র সমালোচনা করে। তাতে কেন্দ্রের মন্ত্রী, উপরাষ্ট্রপতি থেকে তাবড় নেতাদের কলেজিয়াম পদ্ধতির সমালোচনা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন বিচারপতিরা। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ঠিক সেই দিন মন্ত্রী বিচারপতি নিয়োগে কলেজিয়াম কমিটিতে সরকারের প্রতিনিধির উপস্থিতি চাই জানিয়ে প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দিয়েছেন। এদিন মন্ত্রীর সেই চিঠির খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ায় দেশ জুড়ে শোরগোল পড়ে গেছে। বিরোধীরা জানাচ্ছেন, বিচার ব্যবস্থা দখলে নিতে এখন বিচারক নিয়োগের সংস্থা কলেজিয়াম ব্যবস্থাকে এখন দখলের অভিযান চালাচ্ছে বিজেপি।
প্রসঙ্গত, বিজেপি ক্ষমতায় এসে বিচার ব্যবস্থার দখলে নিতে বিচারক নিয়োগে যে কলেজিয়াম ব্যবস্থা রয়েছে তা তুলে দেওয়া নিয়ে লাগাতার অভিযান চালিয়েছে। এবারে পথ বদলে সেই কলেজিয়াম নিয়োগ কমিটিতে সরকারের সদস্য রেখে সেই বিচারক নিয়োগ ব্যবস্থার দখল নিতে চাইছে বিজেপি। স্বয়ং আইনমন্ত্রী কিরণ রিজিজু বলেছেন, এই কলেজিয়ামে বিচারক নিয়োগ ব্যবস্থা পুরো অস্বচ্ছ। এতে বিচারক নিয়োগে বেনিয়ম হয়। এই ব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গে বেমানান, তাই তা তুলে দেওয়া উচিত। উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড় কলেজিয়াম পদ্ধতি তুলে দেওয়ার কথাই জানিয়েছেন। মোদী সরকার ২০১৪ সালে কলেজিয়াম পদ্ধতি বাতিল করে বিচারক নিয়োগে ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন (এনজেএসি) আইন তৈরি করে। সুপ্রিম কোর্ট সাংবিধানিক বেঞ্চ ২০১৫সালে এনজেএসি আইন সুপ্রিম কোর্টের মূল কাঠামোকে লঙ্ঘন করছে বলে তা বাতিল করে দেয়। সুপ্রিম কোর্টের সেই রায়কে আমল দেননি ধনখড়। তিনি বলেছেন, সংসদের রায় খারিজের অধিকার নেই সুপ্রিম কোর্টের। এমনকি অধ্যক্ষ ওম বিড়লা এই কলেজিয়াম পদ্ধতিতে বিচারক নিয়োগে সংসদের যে অধিকার খর্ব করেছে বলেও জানিয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে কলেজিয়াম নিয়োগ পদ্ধতির উন্নতিতে সরকারের কোনও প্রস্তাব থাকলে তা সুপ্রিম কোর্ট কলেজিয়ামকে জানানোর নির্দেশ দেয়। এর পরে কেন্দ্র নিয়োগের মেমোরান্ডাম অব প্রসিডিওর তৈরি করে তা আলোচনার জন্য সুপ্রিম কোর্ট কলেজিয়ামে পাঠায়। কিন্তু কেন্দ্রের সেই নিয়োগ প্রক্রিয়াতেও ছিল কেন্দ্রের আধিপত্য। ফলে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে কেন্দ্রের আলোচনায় সেই প্রক্রিয়ার কোনও ফয়সালা হয়নি। এবারে প্রায় সাত বছর বাদে এনজেএসি আইন খারিজ করে রায়ে যে কলেজিয়ামের উন্নয়নে যে প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে তা উল্লেখ করেই মন্ত্রী রিজিজু কলেজিয়াম কমিটিতে সরকারের প্রতিনিধিদের রাখার প্রস্তাব দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। কলেজিয়াম পদ্ধতি বাতিলের বদলে কলেজিয়াম কমিটিতে সরকারের প্রতিনিধি রেখে তার দখল নিতে চাইছে কেন্দ্র।
মন্ত্রী রিজিজু সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে পাঠানো চিঠিতে জানিয়েছেন, বিচারক নিয়োগ নিয়ে মেমোরান্ডাম অব প্রসিডিওর নিয়ে বিচারবিভাগের সঙ্গে আলোচনা হলেও তাতে কোনও ফয়সালা হয়নি। বিচারক নিয়োগের কলেজিয়াম পদ্ধতিতে যে সার্চ কাম ইভ্যালুয়েশন কমিটি রয়েছে তাতে এবারে সরকারের প্রতিনিধিদের রাখার প্রস্তাব রাখছি। এতে কলেজিয়াম নিয়োগ ব্যবস্থা আরও উন্নত হবে। স্বচ্ছ হবে। রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিদের সেই কমিটিতে সদস্য থাকা উচিত। এতে বিচারপতি নিয়োগে সমাজের সকল অংশের প্রতিনিধিত্ব আসবে বলে দাবি করা হয়েছে চিঠিতে। তিনি জানান, হাইকোর্টে যে কলেজিয়াম রয়েছে তাতে যেমন রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিরা থাকবেন একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টে কলেজিয়ামে ব্যবস্থা রয়েছে তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিরা থাকবেন। এনিয়ে নতুন করে কলেজিয়ামের সার্চ কাম ইভ্যালুয়েশন কমিটি গঠনের দাবি জানান রিজিজু। গত ৬জানুয়ারি প্রধান বিচারপতিকে রিজিজু চিঠি পাঠালেও তার প্রস্তাব নিয়ে এখনও কলেজিয়ামে কোনও আলোচনা হয়নি। এদিকে বিচারমন্ত্রক সূত্রে খবর, মন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের রায় উল্লেখ করেই সরকারের প্রতিনিধি রেখে নতুন নিয়োগ কমিটি গঠনের প্রস্তাব যা দিয়েছেন তা খারিজ হলে এনিয়ে সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠনের দাবি জানিয়ে মামলা দায়ের করার উদ্যোগ নেবে কেন্দ্র। সরকারি প্রতিনিধি নিয়ে কমিটি গঠনে সুপ্রিম কোর্টকে বাধ্য করতে প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে নতুন কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়ে চিঠি দেওয়া হলো বলে জানাচ্ছে অভিজ্ঞ মহল।
এদিকে মন্ত্রীর কলেজিয়াম নিয়োগে ব্যবস্থা সরকারি প্রতিনিধি নিয়োগের চিঠির তীব্র বিরোধিতা করেছেন বিরোধী দল ও বিশিষ্ট আইনজীবীরা। আইনজীবী কপিল সিবাল বলেন, কলেজিয়াম পদ্ধতির বিরুদ্ধে বিজেপির মন্ত্রী, উপরাষ্ট্রপতি থেকে সব নেতা যা বলছেন তা গ্রহণযোগ্য নয়। তারা এতে সুপ্রিম কোর্টে খারিজ হওয়া এনজেএসি আইনে বিরোধী দলের সমর্থনের কথা বলছে। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন দেখা যাচ্ছে যে বিচারপতি সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলছেন তাঁদের নিশানা করছে কেন্দ্র। তাঁদের পদোন্নতি বন্ধ করে দিচ্ছে। এখন কলেজিয়ামের বিরোধিতার কথা বলে আসলে বিচারপতি নিয়োগে পুরো নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চাইছে মোদী সরকার। এভাবে বিচার ব্যবস্থাকেই পদানত করতে চাইছে মোদী সরকার। কংগ্রেস মুখপাত্র জয়রাম রমেশ বলেন, উপরাষ্ট্রপতি ধনখড়, মন্ত্রী রিজিজু, অধ্যক্ষ ওম বিড়লা সহ সব বিজেপি নেতারা একসুরে কার্যত সন্ত্রস্ত করতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ ব্যবস্থাকে আক্রমণ শুরু করেছেন। আক্রমণ আরও বাড়িয়ে একসময় তারা আদালত দখল করে নেবে। কলেজিয়ামের ব্যবস্থায় সরকারি প্রতিনিধি রেখে বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ পুরোপুরি সেই লক্ষ্যেই বলে জানান রমেশ। তিনি বলেন, মন্ত্রী আসলে সংস্কার নয় বিষের বড়ির ব্যবস্থা করেছে আদালত ব্যবস্থার জন্য। আরজেডি’র সাংসদ মনোজ কুমার ঝা বলেন, বিচার বিভাগকে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করতে চায় মোদী সরকার। তারা চায় সরকারের প্রতি বিচার বিভাগের প্রশ্নহীন আনুগত্য। তাই বিচারপতি নিয়োগেও চাই নিয়ন্ত্রণ। সেই নিয়ন্ত্রণ রাখতে নিয়োগ কমিটিতে সরকারি প্রতিনিধির আধিপত্য চান মন্ত্রী। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে চিঠি পাঠিয়েছেন মন্ত্রী। এদিন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেন, আইনমন্ত্রী বিচারপতি নিয়োগে যে ব্যবস্থা নিতে চাইছেন তা বিপজ্জনক পদক্ষেপ। আসলে দেশের কোনও সরকারের উচিত নয় বিচারপতি নিয়োগে হস্তক্ষেপ করা। সেই বিচারপতি নিয়োগে এখন সরাসরি করতে চাইছে কেন্দ্র। কংগ্রেস নেতা আইনজীবী মনীশ তেওয়ারি বলেন, দেশের সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান দখল করেছে মোদী সরকার। বাকি আছে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা। তাদের এবারে দখল করে সরকারের অধীনস্ত করতে চাইছে মোদী সরকার।
Comments :0