পেগাসাস স্পাইওয়্যার নিয়ে বেকায়দায় পড়ে এখন ভারত সরকার একই চরিত্রের আরেকটি নজরদারি স্পাইওয়্যার কিনতে চলেছে। ইজরায়েলী সংস্থা এনএসও’র তৈরি পেগাসাস ব্যবহার করে আড়ি পাতা হয়েছিল দেশের বিরোধী নেতা, সমাজকর্মী, সাংবাদিকদের মোবাইলে। সেই ঘটনা প্রকাশ্যে এসে যায়। পেগাসাস অন্য কয়েকটি দেশেও ব্যবহৃত হওয়ায় প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে। এবার নজর এড়িয়ে অন্য এক স্পাইওয়্যার কেনার জন্য তৎপরতা শুরু করেছে ভারত সরকার।
‘ফিনান্সিয়াল টাইমস’ পত্রিকায় প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ভারতের প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা অফিসাররা এনএসও’র বদলে অন্য সংস্থার স্পাইওয়্যার কিনতে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছেন। প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে এই কাজে। এই বরাতের কাজ সম্পর্কে অবহিত সূত্র উদ্ধৃত করে পত্রিকাটি জানিয়েছে, গ্রিসের ইন্টেলেক্সা সংস্থার সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। তাদের ‘ প্রেডেটর ’ নামের স্পাইওয়্যার রয়েছে। এটিও ইজরায়েলী সামরিক বাহিনীর প্রাক্তনরা তৈরি করেছে। যদিও এই স্পাইওয়্যার নিয়ে গ্রিসে শোরগোল পড়েছিল। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও গোয়েন্দা প্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। এই স্পাইওয়্যার সৌদি আরব, মিশর, মাদাগাস্কার, ওমানে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে খবর। এছাড়াও অন্য কয়েকটি ইজরায়েলী সংস্থার সঙ্গেও কথা চলছে। ‘কোয়াড্রিম’ নামের স্পাইওয়্যার ইজরায়েলেই তৈরি হয়। সৌদি আরবে তা বিক্রির জন্য সরকারি অনুমোদন মিলেছে। উল্লেখ্য, পেগাসাসের ক্ষেত্রেও এনএসও জানিয়েছিল ইজরায়েল সরকারের অনুমতি ছাড়া তারা এই স্পাইওয়্যার বিক্রি করে না। ‘কগনাইট’ নামের আরেকটি স্পাইওয়্যারের জন্যও কথা বলা হচ্ছে। এই স্পাইওয়্যার দিয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হওয়ায় এই সংস্থার শেয়ার বাজেয়াপ্ত করেছিল নরওয়ে।
তবে, এছাড়াও অন্য কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ইতালি, সাইপ্রাসের কয়েকটি সংস্থাও গোপন নজরদারির এমন স্পাইওয়্যার তৈরি করে। ইজরায়েলের এনএসও এই স্পাইওয়্যারের ব্যবসায়ে শীর্ষে ছিল। কিন্তু বিভিন্ন দেশেই তাদের স্পাইওয়্যারের কথা ফাঁস হয়, বিতর্ক তৈরি হয়। চাপের মুখে এমনকি মার্কিন প্রশাসনও এনএসও’র স্পাইওয়্যার ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। তাছাড়াও সিটিজেনস ল্যাবের মতো ফরেনসিক কোম্পানি পেগাসাসের কাজের পদ্ধতি চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে। সহজ কথায়, পেগাসাস ব্যবহার হচ্ছে কিনা তা ধরতে পারছে। এই অবস্থাতেই নতুন স্পাইওয়্যারের খোঁজ বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের একটি কনসর্টিয়াম ২০২১-এর জুলাই মাসের মাঝামাঝি সামনে আনে বিশ্বের দেশে দেশে ইজরায়েলের এনএসও সংস্থার তৈরি স্পাইওয়্যারের মাধ্যমে নজরদারির কাহিনি। ভারতেরও অনেক নাম সেই তালিকায় ছিল।
সাংবাদিক, বিরোধী রাজনৈতিক নেতা, সমাজকর্মীদের মোবাইলে গোপনে এই স্পাইওয়্যার ঢুকিয়ে আড়ি পাতা হয়েছে বলে অভিযোগ। তার ফলে টেলিফোন কথাবার্তা, সোশাল মিডিয়ার বার্তা আদান-প্রদান, ব্যক্তিগত কথাবার্তা সবই নজরদারির আওতায় চলে এসেছে। এই স্পাইওয়্যারটি এমনই যে যেমন গোপনে তা মোবাইলে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তেমন গোপনেই তা সরিয়ে নেওয়া যায়।
ভারতে এই সংবাদ নিয়ে শোরগোল ওঠে। সিটিজেন্স ল্যাব ফরেনসিক সংস্থার পরীক্ষাতেও ভারতে পেগাসাসের ব্যবহার প্রমাণিত হয়। এই নিয়ে মামলা দায়ের হয় শীর্ষ আদালতে। স্বাধীন তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালতের নজরদারিতে এই তদন্ত করে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি আর ভি রবীন্দ্রনের নেতৃত্বে এক কমিটি। এই কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল, কেন্দ্রীয় সরকার তদন্ত কমিটির সঙ্গে কোনও সহযোগিতা করেনি। অভিযোগ এই যে সরকার নিজেই এই স্পাইওয়্যার কিনে ব্যবহার করেছে। সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলার সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে কোনোভাবেই ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলা হয়নি। যে হলফনামা পেশ করা হয়েছিল সেখানেও বলা নেই কেন্দ্রীয় সরকার পেগাসাস কেনেনি বা কিনেছে। সুপ্রিম কোর্টও এই ধোঁয়াশা সম্পর্কে ক্ষোভ জানিয়েছিল। তারপরেই শীর্ষ আদালত স্বাধীন তদন্তের নির্দেশ দেয়।
ভারতের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক স্তর থেকেই এই স্পাইওয়্যার কেনার জন্য আগ্রহ ও তৎপরতা দেখানো হয়েছিল। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সর্বোচ্চ স্তর থেকে ইজরায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই সামরিক স্তরের স্পাইওয়্যার কেনা হয়েছে। ২০১৭-র ফেব্রুয়ারিতে ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ইজরায়েলে গিয়েছিলেন। এইসব গোয়েন্দা সংস্থার মাথায় তিনিই বসে আছেন। সে বছরের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ইজরায়েল সফরের সময়ে পেগাসাস কেনার চুক্তি হয়ে যায়। ভারত ও ইজরায়েলের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা স্তরে পেগাসাস নিয়ে গোপন চুক্তি হয়েছিল। মোদী সরকারের তরফে ‘নির্দিষ্ট আগ্রহ’ ও ‘নির্দিষ্ট জোর’ দেওয়া হয়েছিল বলেই ২০১৭ সালে ওই স্পাইওয়্যার কেনে ভারত।
রবিবার এই সংবাদ প্রসঙ্গে সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, নজরদারি রাষ্ট্রের কাঠামোকে আরো মজবুত করছে মোদী সরকার। পেগাসাস ছাড়াও আরও স্পাইওয়্যার কেনা হচ্ছে।
Comments :0