Nalanda University

সমালোচক, নালন্দায় অমর্ত্য সেনকেই ভোলানোর চেষ্টায় মোদী-নীতীশ

জাতীয়

সৌরভ গোস্বামী

গত দশ বছরে এই প্রথম বিহারের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রাজনৈতিক প্রচারের জন্য তিনি নিয়মিত বিহারে গেলেও ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়া ঐতিহাসিক ঐতিহ্যবাহী এই স্থানে এটিই তাঁর প্রথম সফর। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাসের উদ্বোধন করেছিলেন তিনি, তার ধ্বংসাবশেষের চারপাশে ঘুরে বেড়াতে এবং নিজের ছবি তুলতে যথেষ্ট উৎসাহ ঝরে পড়তে দেখা গিয়েছে তাঁর চালচলনে।
প্রধানমন্ত্রী এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার, উভয়েই প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের ভূমিকা নিয়ে আলোকপাত করেছিলেন। বলেছিলেন যে কালাম এই প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়টিকে পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়টিকে উৎসাহের সঙ্গে সমর্থন করেছিলেন। খুব স্বাভাবিকভবেই অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বা আরও উৎসাহদাতাদের উল্লেখ সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন উভয়েই। 
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক পঙ্কজ মোহন এই ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে একটি ফেসবুক পোস্ট করেছেন সম্প্রতি।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করতে বাধ্য হওয়া এবং বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া নিবাসী বিশিষ্ট চিন্তাবিদ অধ্যাপক মোহন কোরিয়ায় তাঁর চাকরি ছেড়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়টিকে পুনর্গঠন করার জন্য তাঁর নিজের রাজ্যে ফিরে এসেছিলেন। আরএসএস’র হাতে অপমানিত অধ্যাপক সেনের পদত্যাগের পরে, একাডেমিক বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ করে, অধ্যাপক মোহন এবং আরও কয়েকজনও হতাশ হয়ে চলে যান।
অধ্যাপক মোহন দুঃখের সঙ্গে স্মরণ করেছেন যে তিনিই ২০১৭ সালে ক্যাম্পাস নির্মাণের বরাত দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মোদী গত বুধবার উদ্বোধনের সময় তাঁর একার কৃতিত্ব জাহির করেছেন। মোহন এবং তৎকালীন আচার্য ডাঃ বিজয় ভাটকর ভূমি পুজোয় অংশ নিয়েছিলেন। তবে ক্যাম্পাসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেখানো তথ্যচিত্রে প্রয়াত সুষমা স্বরাজের নামও উল্লেখ করা হয়নি, যিনি এনডিএ সরকারের বিদেশমন্ত্রী হিসাবে এখানে পঠনপাঠন শুরু করার ক্ষেত্রে কিছু ভূমিকা নেন।
মোহন আরও স্মরণ করিয়েছেন যে ২০১৪ সালে, অধ্যাপক সেন ইন্দোনেশিয়ায় তাঁর বক্তৃতা থেকে প্রাপ্ত ২০ লক্ষ টাকা অনুদান দিয়েছিলেন অভাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি তহবিল গঠনের জন্য। মূলত তাঁর জন্যই অস্ট্রেলিয়া ও চীন সরকার এবং সুইৎজারল্যান্ডের একজন অনাবাসী ভারতীয় নালন্দাকে ১ মিলিয়ন ডলার করে অনুদান দেন।
মোট ১৮ কোটি টাকা আসে এই খাতে। থাইল্যান্ডও ৬০ লক্ষ টাকা অনুদান দিতে এগিয়ে এসেছিল। অধ্যাপক সেনের অনুরোধে সিঙ্গাপুরের একটি ব্যবসায়িক প্রতিনিধি দল নালন্দায় আসে এবং গ্রন্থাগারের জন্য ৬০ কোটি টাকা (১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
মোহন স্মরণ করিয়ে দেন, অধ্যাপক সেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বা ভারত সরকারের কাছ থেকে কোনও সাম্মানিকও গ্রহণ করেননি। প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর সময় তাঁকে যখন ‘ভারতরত্ন’ সম্মানে ভূষিত করা হয় সেই সময় থেকে এয়ার ইন্ডিয়ায় প্রথম শ্রেণিতে ভ্রমণের জন্য আজীবন বিনামূল্যে পাস ঘোষণা করা হয়। সমস্ত ‘ভারতরত্ন’ প্রাপকদের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। তিনি এই আতিথেয়তার বাইরে কিছুই পাননি। তবে তিনি এবং ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ড: গোপা সাভারওয়াল আরএসএস-বিজেপির দ্বারা অপমানিত হয়েছিলেন এবং বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় তাদের। 
টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাংবাদিক ভারতী জৈন অভিযোগ তোলেন যে অধ্যাপক সেন প্রতি মাসে পাঁচ লক্ষ টাকা বেতন নেন, সীমাহীন বিদেশ ভ্রমণের সুবিধা, পাঁচতারা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা এবং সরাসরি নিয়োগপত্র পান। যখন তাঁকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল এবং জানানো হয়েছিল যে তার অভিযোগগুলির সত্যতা প্রমাণ করতে হবে। তখন তিনি টুইটারে (এখন এক্স) লিখেছিলেন, ‘‘এটি স্বীকার করতে হচ্ছে যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর মেয়াদ সম্পর্কে অধ্যাপক অমর্ত্য সেনকে নিয়ে আমার টুইটগুলি সম্পূর্ণ ভুল ছিল।" তিনি অধ্যাপক সেনের কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলেন।
নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার এই অতীত সংশোধন করতে পারত, কিন্তু তা করেনি, কারণ অধ্যাপক সেন মোদীর শাসনের সমালোচনা করে চলেছেন। হার্ভার্ডে অধ্যাপনা করা অধ্যাপক সুগত বসু, লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সের অধ্যাপক মেঘনাদ দেশাই, হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন চ্যান্সেলর অধ্যাপক ওয়া কুং উ, সুপার কম্পিউটিংয়ে ভারতের উদ্যোগের অন্যতম স্থপতি হিসাবে স্বীকৃত কম্পিউটার বিজ্ঞানী ডঃ বিজয় ভাটকার এবং গভর্নিং বোর্ডে জর্জ ইয়োর মতো পণ্ডিতদের উপস্থিতিতে আশা করা হয়েছিল যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় সত্যই একটি খ্যাতিমান আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে বিকশিত হবে। সেই আশায় জল ঢেলেছে সঙ্ঘ পরিবার। 
কিন্তু অধ্যাপক সেনকে হেনস্থা করে নালন্দা ছাড়তে বাধ্য করার পর তারা সবাই পদত্যাগ করেন। পরবর্তী উপাচার্য অধ্যাপক সুনয়না সিং এশিয়া, ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশিষ্ট অধ্যাপকদের ধীরে ধীরে পদত্যাগ এবং চলে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন। 
মোহন লিখেছেন, বিহারের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে ১৮ তম স্থানে রয়েছে। যদিও, বুধবার নীতীশ কুমার দাবি করেন, ১৭টি দেশের ৪০০ পড়ুয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি রয়েছেন। গত বছর মে মাসে, উপাচার্য হিসাবে তাঁর বর্ধিত ছয় বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার সময়, অধ্যাপক সিং দাবি করেছিলেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘‘৩০টি দেশের ১০০০ শিক্ষার্থী’’ পড়াশোনা করছে!
অনেকে এই সংখ্যা নিয়ে বিদ্রুপ করে বলেছেন যে আন্তর্জাতিক ছাত্রদের সংখ্যা আসলে গুটি কয়েক। ইতিহাস, ভূগোল বা পালির মতো ভাষা পড়ার জন্য ফি যতই অত্যাধিক হোক না কেন, তারা কল্পনাও করতে পারে না যে এত টাকা দিয়ে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে এবং কেন হচ্ছে। 
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৫০০ বছরেরও বেশি আগে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে নব্বই লক্ষ বই এবং সারা বিশ্ব থেকে ১০,০০০ শিক্ষার্থী ছিল বলে জানা যায়। বিশ্বের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে বিবেচিত, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা, যুক্তি, গণিত এবং সর্বোপরি বৌদ্ধ দর্শন পড়ানো হলেও মোদী জমানায় এই বিশ্ববিদ্যালয়কে সঙ্গে সুকৌশলে হিন্দুত্ববাদের পীঠস্থান বলে চালানো হচ্ছে।

Comments :0

Login to leave a comment