Editorial

জলের দরে টাকা

সম্পাদকীয় বিভাগ

রীতিমতো পাল্লা দিয়ে শেয়ার বাজারে যেমন ধস নেমে চলেছে তেমনি ডলারের নিরিখে অবাধ পতন ঘটে চলেছে ভারতীয় মুদ্রা টাকার। বস্তুত গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে শেয়ার বাজারে এবং টাকার মূল্যে যে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে তা বন্ধ হবার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং রক্তক্ষরণের মাত্রা যেন বাড়ছে। মনমোহন সিংয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে টাকার মূল্য পতন নিয়ে যিনি ক্রমাগত আক্রমণ শানাতেন এবং ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করতেন সেই নরেন্দ্র মোদীর মুখে এখন কুলুপ। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের আগে ডলারের বিনিময় মূল্য যখন ছিল ৫৮ টাকা তখন নির্বাচনী প্রচারে এই মোদী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ক্ষমতায় এলে ডলারের মূল্য ৪০ টাকায় নামিয়ে আনবেন। তাঁর দল ক্ষমতায় এসেছে তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন কিন্তু টাকার মূল্য বাড়েনি। বরং যেকোনও সময়ে টাকার মূল্য পতনের গতিকে ছাড়িয়ে মোদী জমানায় ডলারের বিনিময়মূল্য সর্বকালীন রেকর্ড সৃষ্টি করে ৮৬.৫৯ টাকা হয়ে গেছে। অর্থাৎ মনমোহন সিংয়ের জমানায় টাকার মূল্য পতন যতটা হয়েছে মোদী জমানায় সেটা দ্বিগুণের কাছাকাছি হয়ে গেছে। এরপর কোন লজ্জায় টাকার মূল্য নিয়ে তিনি কথা বলবেন। অতএব মৌনীবাবা হয়ে থাকাই লজ্জা নিবারণের সেরা পথ।
বিদেশি মুদ্রার বাজারে যে মুদ্রার বাড়ে খোলা বাজারের নিয়ম অনুযায়ী সেই মুদ্রার দাম বাড়ে। ভারতের শেয়ার বাজার থেকে বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক লগ্নিকারীরা লাগাতার লগ্নি তুলে নিয়ে যাবার ফলে বাজারে ডলারের দাম বাড়ছে। মার্কিন অর্থনীতি চাঙ্গা হবার লক্ষণ দেখা দেওয়ায়, বেকারি একটু কমায় এবং সুদের হার না কমার সম্ভাবনায় প্রাতিষ্ঠানিক লগ্নি আমেরিকায় পাড়ি দিচ্ছে। তাই স্বাভাবিক নিয়মেই ডলার শক্তিশালী হচ্ছে। উলটো দিকে ভারতের অর্থনীতি বৃদ্ধির গতি ঢিলে হয়ে যাওয়ায়, কাজের সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ায়, মানুষের রুজি এবং ক্রয় ক্ষমতা না বাড়াই, বাজারে পণ্য পরিষেবার চাহিদা না বাড়ায় টাকার মূল্যে প্রবল নেতিবাচক চাপ তৈরি হচ্ছে। রুশ তেলের উপর নতুন করে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম অনেকটা বেড়ে গেছে। ফলে সস্তায় রুশ তেলের বদলে অন্যত্র থেকে অনেক বে‍‌শি দামে তেল আমদানি করতে হবে। লাগবে অনেক বেশি বিদেশি মুদ্রা। তেমনি ডলারের দাম বাড়ায় ভারতের আমদানি ব্যয়ও অনেক বেড়ে যাবে। তাতে বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি বাড়বে। যত ঘাটতি বাড়বে তত বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ে টান পড়বে। ভারতের ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের অনেক কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। তাতে ব্যয় বেড়ে যাবার ফলে উৎপাদিত পণ্যের মূল্যও বেড়ে যাবে। সেটা দেশে মূল্যবৃদ্ধিকে উসকে দেবে। মূল্যবৃদ্ধির হার বাড়লে সুদের হার কমানোর ঝুঁকি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নেবে না। টাকার মূল্য পতনে বিদেশে ভ্রমণ এবং শিক্ষার জন্য যাওয়ার খরচ অনেক বেড়ে যাবে। আবার মূল্য যত কমবে ততই মূলধনী বাজারে বিদেশী লগ্নি কমে যাবে। সেটা অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশারই ইঙ্গিত দেয়। অর্থাৎ সব মিলিয়ে অর্থনীতি গোলোক ধাঁধা‌য় পড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই চক্রব্যুহ থেকে বেরুবার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। তাই মোদীরা কথা হারিয়ে ফেলেছেন। টাকার মূল্য নিয়ে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা ছাড়া তাদের করার কিছু নেই।

Comments :0

Login to leave a comment