মুরলীধর বুধা মিসার: বাসিন্দ (মুম্বাই)
আপ্পা বোটনা মোর বয়সটা বেশ কম। তরুণ সেই কিষানের মুখে খানিকটা ‘আত্মপ্রচার’। শনিবার দুপুরে প্রায় খালি হয়ে যাওয়া ইদগাহ ময়দানে দাঁড়িয়ে মিডিয়াকে বাইট দিচ্ছিলেন ডিন্ডোরি থেকে আসা সেই জোয়ান। বললেন, ‘একটা সময় ছিল কৃষকদের ব্যাপারটা সেকেন্ডারি ছিল। আমরাই তো কিষানের আন্দোলনকে ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়েছি।’ চোখে মুখে স্পষ্ট লড়াই করে জয় ছিনিয়ে নেওয়ার গৌরব। বৃহস্পতিবার রাতেই মিলেছিল যুদ্ধ জয়ের ইঙ্গিত। গতকাল বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী ‘কৃষকদের সব দাবি মেনে নেওয়ার’ ঘোষণা আর প্রশাসনিক বিজ্ঞপ্তি জারি এসবে স্পষ্ট হয়ে যায় জিত। তবু আপ্পারা তাঁবু ফেলে বসেছিলেন রাতের বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া ইদগাহ ময়দানে। নেতারা না বলা পর্যন্ত নড়বেন না।
আজ সকালে সমাবেশ থেকে কিষান নেতা তথা প্রাক্তন বিধায়ক জে পি গাভিট ঘোষণা করলেন, সরকার ১৪দফা দাবির সবটাই মেনে নিয়েছে। কৃষকদের দাবিগুলি কীভাবে পূরণ হবে সে সম্পর্কে রিপোর্ট দেবার জন্য কমিটি তৈরি করেছে সরকার। লিখিতভাবে কিষান সভাকে সে সমস্ত কিছুই জানিয়েছে সরকার। গাভিট বললেন, যে সরকার ও পুলিশ আগে আন্দোলন বানচাল করতে নেমেছিল, তারাই পরে লং মার্চের জোশ দেখে কথা বলতে বাধ্য হয়েছে। ‘আমাদের সব দাবি মেনে নেওয়ার জন্য ওদের ধন্যবাদ’, সমাবেশে বললেন গাভিট।
আপাতত এই আন্দোলন তুলে নেওয়ার গাভিটের ঘোষণার পরই ময়দানজুড়ে শুরু হয়ে যায় ঘরে ফেরার প্রস্তুতি। শুরু হলো সঙ্গে বেঁধে আনা চাল-গম, ডাল, সবজি, বাসন-কোসন গুছিয়ে নেওয়ার পালা। আরেকদিকে তখন তাঁবু খোলার কসরত। সঙ্গে আনা ট্রাক্টর-ট্রলিতে সেগুলি চাপিয়ে একদল রওনা দিয়ে দিল নিজের নিজের গ্রামের পথে। বাকিরা বাসিন্দা থেকে নাসিকের ট্রেন ধরবেন বলে অপেক্ষায় রইলেন। রাজ্য সরকার আন্দোলনরত কিষানদের বাড়ি ফেরার জন্য বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে। আরো কিছু লোক তখনও রয়ে গেছেন সড়ক পথে ১২০ কিলোমিটার দূরের নাসিকে ফিরবেন বলে।
তাঁদেরই একজন কিষান সভার তরুণ কর্মী আপ্পা। মারাঠী মেশানো হিন্দিতে বললেন, ‘২০১৮-র প্রথম লং মার্চের পর এদেশে কৃষকদের সমস্যার কথাটা সামনে চলে এসেছিল। তারপরই তো একবছরেরও বেশি সময় ধরে গোটা ভারত দেখলো এক সফল কৃষক আন্দোলন। এবার আবার আমরা আন্দোলন নামলাম। আর সমস্ত দাবি আদায় করেই ফিরছি।’
কিষান সভার মহারাষ্ট্র রাজ্য কমিটির ডাকে এই সফল আন্দোলনকে অভিনন্দন জানিয়েছে সারা ভারত কিষান সভার কেন্দ্রীয় কমিটি। অশোক ধাওয়ালে ও বিজু কৃষ্ণান স্বাক্ষরিত সেই অভিনন্দন বার্তায় বলা হয়েছে, আদিবাসী, গরিব খেতমজুরদের এই জয় জনবিরোধী বিজেপি সরকার ও তার কর্পোরেটমুখী নীতির বিরুদ্ধে আগামীদিনের জঙ্গি আন্দোলনকে উৎসাহ জোগাবে।
আর সকালে ময়দানে কিষান নেতারা এই আন্দোলনের জয়কে উৎসর্গ করলেন শহীদ কমরেড পুন্ডালিক আমবো যাধভকে। শুক্রবার রাত আটটা নাগাদ রাতের খাওয়ার পরই অসুস্থ বোধ করেন ডিণ্ডোরির কাছের এক গ্রাম থেকে আসা বছর আটান্নর পুণ্ডালিক। বমিও করেন। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শাহপুরের হাসপাতালে। কিন্তু পথেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। সকালে কিষান নেতা অজিত নাওলে জানালেন, সকালেই ময়নাতদন্তের পর শহীদ কমরেডের মরদেহ তাঁর গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানেই তাঁর শেষকৃত্য হবে। আন্দোলন চলাকালীন এই কৃষকের মৃত্যুর ঘটনায় রাজ্য সরকার তাঁর পরিবারের জন্য পাঁচ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছেন।
এই এক শহীদের প্রাণ আর হাজার-হাজার কৃষক-শ্রমিকের যন্ত্রণা-কষ্টের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনা এই জয়ে অনুপ্রাণিত আরেক কৃষক নেতা জিতেন্দ্র চোপদের কথায়, এআইকেএস’র উপর আস্থা ছিল কৃষকদের। সঙ্গে হুঁশিয়ারির সুর, ‘লড়াই জিতেই আমরা বাসিন্দ ছাড়ছি। সরকার যদি আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাহলে ছ’মাস পর আবার আমরা ফিরবো, আরো বড় সংখ্যায়’।
গত কয়েকদিন ধরে ‘একসাথে রান্না করা, একসাথে খাওয়া আর একসাথেই পথ চলা’ এক গ্রামের বাইশজনের দলটার অন্যতম সুকরাম পাওয়ারের কথায়, ‘আমাদের বাপ-দাদারা জমির মালিকানার জন্য লড়তে লড়তে মরে গেছে। আমি চাই না আমার ছেলেমেয়েরাও একই লড়াই লড়তে লড়তে মরুক। তাই এই লড়াইটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ একা পাওয়ার নন, এই একই দাবিতে হাজার হাজার দলিত কৃষক এই লং মার্চে এসেছেন। তাঁদের দাবি বনভূমি আর তাঁরা যে জমি চাষ করেন তার মালিকানা তাঁদেরই দেওয়া হোক। আলাপ-আলোচনা সরকার এই বিষয়টি রূপায়ণে মন্ত্রীসভার একটা প্যানেল তৈরি করেছে। সেই প্যানেলে কিষান নেতা গাভিট ও বিধায়ক বিনোদ নিকোলেকেও নেওয়া হয়েছে। তারা এক মাসের মধ্যে রিপোর্টো দেবে।
কৃষকদের এই সমস্ত দাবির পাশাপাশি এই লং মার্চের ১৪ দফা দাবির মধ্যে শ্রমিকদেরও বেশ কিছু দাবি ছিল। শুরু থেকেই লং মার্চে পথ হাঁটছিলেন শ্রমিক নেতা, সিআইটিইউ’র সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি বি এল কারাড। সরকারের সঙ্গে ম্যারাথন আলোচনাতেও ছিলেন কারাড। এদিন জানালেন, ‘সরকার শ্রমিকদের দাবিগুলি নিয়ে ইতিবাচক। আশা কর্মীদের সাম্মানিক ১৫০০টাকা বাড়াতে রাজি হয়েছে। ঠিকা কর্মীরাও এবার থেকে সরাসরি তাঁদের অ্যাকাউন্টে বেতন পাবেন।’
এদিন সকালে কারাডের কথায় মিললো আগামী দিনের লড়াইয়ের আঁচ। জানালেন, ‘এগুলি ছিল রাজ্যস্তরের দাবি। সামনে আরও বড় ইস্যু রয়েছে। সেই বিষয়গুলি তুলতেই ৫এপ্রিল রাজধানী ঘিরে ফেলবে শ্রমিক-কৃষকরা।’ কারাডের ঘোষণা, ‘মহারাষ্ট্র থেকে প্রায় দশ থেকে ১৫ হাজার কৃষক, শ্রমিক, খেতমজুর সেখানে যাবেন। টিকিট বুকিং চলছে। আর গ্রাম স্তরে, ব্লক-স্তরে সভাও হচ্ছে।’
কারাডের সেই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অনুরণন শোনা গেল আপ্পা বোটনা মোরের কথাতেও। বললেন, ‘৫ তারিখ লক্ষ লক্ষ কৃষক-শ্রমিক দিল্লিতে জমায়েত হবে। আমরা যেমন মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকারকে মাথা নত করতে বাধ্য করেছি, দিল্লিতে একই পরিণাম হবে মোদী সরকারের।’
Comments :0