Mamata bowed down

মাথা নোয়ালেন মমতা

কলকাতা রাজ্য

 অবশেষে কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকে পদ থেকে অপসারিত করছে রাজ্য সরকার!
আন্দোলনের দাবির কাছে মাথা নুইয়ে কলকাতার পুলিশের শীর্ষকর্তাকে সরিয়ে নেওয়ার ঘটনা এরাজ্যে মমতা ব্যানার্জির মুখ্যমন্ত্রীত্বে এই প্রথম। দিন কয়েক আগেই কলকাতার পুলিশ কমিশনার তাঁর কাছে পদত্যাগ করতে এসেছিল, কিন্তু তিনি দুর্গাপুজোর জন্য তাঁকে পদত্যাগ করতে দেননি। আর আজ টানা সাড়ে পাঁচ ঘন্টা জুনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠকের পর মমতা ব্যানার্জিকে আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের দাবি মেনে সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে হয়েছে। পুজোর আগেই সরছে বিনীত গোয়েল। 
তবে সরকার আগামীকাল বিকাল ৪টা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। কালীঘাটের বাড়ি থেকে রাত ১১টা ৫০ মিনিটে সাংবাদিক বৈঠক করে মুখ্যমন্ত্রী জানান, ‘‘আগামীকাল ৪টের মধ্যে কলকাতা পুলিশের বদল আনবো। নতুন কমিশনারকে দায়িত্বভার তুলে দেবেন বিনীত গোয়েল।’’
বিনীত গোয়েলের অপসারণের সঙ্গে কলকাতা পুলিশের ডিসি নর্থকেও আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। একইসঙ্গে স্বাস্থ্য দপ্তরের স্বাস্থ্য অধিকর্তা(ডিএইচএস) ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তাকেও(ডিএমই)কেও পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রধান সচিব নারায়ন স্বরূপ নিগমের অপসারণ রাজ্য সরকার গ্রহণ করে নি। বাকি দাবিগুলি নিয়ে মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে একটি টাস্ক ফোর্স গঠনের কথাও জানান মুখ্যমন্ত্রী। 
বৈঠক থেকে বেরিয়ে জুনিয়র চিকি‌ৎসকরা কালীঘাটে কিছু বলতে চাননি। ধরনা মঞ্চে ফেরার আগে তাঁরা জানিয়ে দেন, ‘‘বৈঠকের কিছু দাবির মীমাংসা হয়েছে। কিছু দাবি হয়নি। কর্মবিরতি প্রত্যাহার নিয়ে আলোচনা করে ধরনা মঞ্চ থেকে ঘোষণা হবে।’’ পরে ধরনা মঞ্চে ফিরে ডাক্তারদের তরফ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, শুধুমাত্র টাস্ক ফোর্স গঠন করে সমস্যার সমাধান হবে না। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যে দুর্নীতি, থ্রেট কালচার তৈরি হয়েছে তা সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে।  এ বিষয়ে ভবিষ্যতে আলোচনার পথ খোলা রয়েছে বলেও জানিয়েছেন ডাক্তারেরা। তাঁরা বলেন, “যেটুকু দাবি আমরা পূরণ করিয়ে আনতে পেরেছি সেটাও আমাদের আন্দোলনের জয়। এটুকু পেতে আমাদের ৩৮ দিন সময় লেগে গেল। দাবির বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের শুনানি রয়েছে সে দিকে নজর থাকবে আমাদের। এ ছাড়াও কত দিনে আমাদের দাবিগুলি বাস্তবায়িত হয় সে দিকেও নজর থাকবে আমাদের।”
তবে মুখ্যমন্ত্রী এদিন দাবির একটা বড় অংশকে মান্যতা দিয়ে বিকাল ৪টা পর্যন্ত সময় দেওয়ার পিছনে আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকরা ধরনা মঞ্চ থেকে কী সিদ্ধান্ত নেয় তার অপেক্ষায়। তবে এদিন দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর আন্দোলনকারীদের পক্ষে ৪২জন ও রাজ্য সরকারের পক্ষে মুখ্যসচিব বৈঠকের কার্যবিবরণীতে স্বাক্ষর করেন।
সোমবার তিন দফায় ই-মেল চালাচালির পর সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিট নাগাদ মমতা ব্যানার্জির কালীঘাটের বাড়িতে বৈঠক শুরু হয়ে যায়। প্রায় দু ঘন্টা ধরে বৈঠক চলে। রাত পৌনে নয়টা বৈঠক শেষ হওয়ার পরও কার্য বিবরণীর বয়ান নিয়ে শুরু হয় টানা পোড়েনে। সেই টানা পোড়েন রাত ১১টা পর্যন্ত চলেছে। যার অর্থ, দু ঘন্টা বৈঠকের পর কার্য বিবরণীতে স্বাক্ষরের আগে সরকার ও জুনিয়র চিকিৎসকদের টানাপোড়েনেই চলে গেছে আরও দু ঘন্টা। রাত ১১টা বাজে এখনও সরকারের পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি। আন্দোলনকারী জুনিয়ার চিকিৎসকদের বাসও মমতা ব্যানার্জির বাড়ির গলিতে অপেক্ষা করছে, তাতে একজনও আন্দোলনকারীকে উঠতে দেখা যায়নি।
আন্দোলনকারীদের পাঁচ দফার মধ্যে অন্যতম কলকাতার পুলিশ কমিশনারের 
অপসারণ। একইসঙ্গে স্বাস্থ্য সচিব সহ স্বাস্থ্য অধিকর্তা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তার পদত্যাগ। সরকারের তরফে গত চার পাঁচদিন ধরেই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকার কথা উল্লেখ করে হাসপাতালের ভিতরে নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিষয়কে সামনে আনা হয়েছে। সূত্রের খবর, এদিন বৈঠক ও তার পরবর্তী কালে কার্য বিবরণী নিয়ে সেই জটিলতাই চলছে।
নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে বৈঠকে যোগ দেওয়ার সময় আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন সংগ্রহ করে নেয় সরকারি নিরাপত্তাকর্মীরা। ফলে ভিতরে কী আলোচনা হচ্ছে, তার কোনো খবর পৌঁছায়নি স্বাস্থ্য ভবনের ধরনা মঞ্চে। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সরকারি স্তর থেকেও কোনো তথ্য বাইরে না আসায় ধরে নেওয়া যায়, নিজেদের পাঁচ দফা দাবিতো অনড় আছে জুনিয়র চিকিৎসকরা। রাত পৌনে দশটা থেকে প্রশাসনের তরফ থেকে বলা হচ্ছিল, মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করবে। কিন্তু ১১টা বেজে যাওয়ার পরও তার কোনো লক্ষণ নেই। 
তাৎপর্যপূর্ণভাবে এদিন চিকিৎসকদের বাসকে সোজা মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের গলির মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যাতে কোনোভাবে বাস থেকে তাদের নামা ও জাস্টিস ফর আর জি কর স্লোগানের আওয়াজ না ধরা পড়ে। তবে এদিন বৈঠকের জন্য কালীঘাট চত্বরে বহু সাধারণ মানুষ ভিড় করেন। আন্দোলনাকারীদের পক্ষ নিয়ে আগত মানুষ বিচারের দাবি নিয়ে স্লোগান তোলেন।

সুপ্রিম কোর্টে বুধবার তৃতীয় দফার শুনানির আগে কৌশলগত কারণে রাজ্য সরকার এদিন ফের জুনিয়র চিকিৎসকদের কাছে আলোচনায় বসার বার্তা পাঠায়। রাজ্যের মুখ্যসচিবের তরফ থেকে পাঠানো বার্তাতেও এবার তাৎপর্যপূর্ণভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সরকারের তরফে এটাই শেষবারের মতো আলোচনায় বসা। একইসঙ্গে চিঠিতে সভার কার্যবিবরনীতে দু পক্ষের স্বাক্ষর থাকার কথা জানিয়ে বিকাল ৪টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে কালীঘাটে মমতা ব্যানার্জির বাসভবনে চলে আসতে বলা হয়েছিল আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকদের। বিকাল ৫টায় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের কথাও লেখা চিঠি চিঠিতে।
মুখ্যসচিবের ই-মেল পাঠানো হয়েছিল সকাল পৌনে ১২টায়। তারপরই নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসে দুপুর ৩টা ৫০ মিনিট নাগাদ মুখ্যসচিবের উদ্দেশ্যে ই-মেল করে চিকিৎসকরা গত ৪৮ ঘন্টায় আর জি কর ঘটনার দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করেন। প্রথমত যদি চিকিৎসক পড়ুয়াকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের গ্রেপ্তারি। দ্বিতীয়ত তথ্য প্রমাণ লোপাটের দায়ে টালা থানার ওসি’কে সিবিআই’এর হেফাজতে নেওয়া। সরকারকে দেওয়া ই-মেলে একথা জানিয়ে স্বচ্ছতার স্বার্থে বৈঠকের সরাসরি সম্প্রচার জরুরী বলে দাবি করে আন্দোলনকারীরা। সরাসরি সম্প্রচার সম্ভব, ভিডিওগ্রাফি সম্ভব না হলে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে একতরফা ভিডিও করে বৈঠকের পরপরই তা চিকিৎসক প্রতিনিধিদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা জানানো হয়েছিল। সেটাও যদি সম্ভব না হয়ে থাকে, তাহলে বৈঠকে দু তরফেই আলোচনার খুঁটিনাটি লিখিতভাবে নথিভুক্ত করবে। তারপর বৈঠক শেষে দু পক্ষই স্বাক্ষর করে আলোচনার মিনিটস হস্তান্তর করে নেবে।
সরাসরি সম্প্রচার, ভিডিওগ্রাফি দাবি ছেড়ে গত শনিবারই মুখ্যমন্ত্রীই পরামর্শ দিয়েছিলেন, বৈঠকের মিনিটস করে  দু পক্ষের সই করে দেব। শেষ পর্যন্ত এই দাবি মেনে নিলেও রাজ্য সরকারের তরফ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, বৈঠক হবে না। রাজ্যের স্বাস্থ্য রাষ্ট্রমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য জানিয়ে দিয়েছিলেন, দেরি হয়ে গেছে। আপনারা চলে যান। না হলে বাস ডেকে তুলে দেওয়া হবে।’’
এদিনও রাজ্য সরকারের তরফে পাঠানো মুখ্যসচিবের চিঠিতে কার্যবিবরণীতে দু পক্ষের স্বাক্ষরের কথা থাকলেও আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা প্রশ্ন তোলেন, বৈঠকের এই কার্য বিবরণী দু পক্ষই লিখবে। তারপর তা দু পক্ষ দেখে নিয়ে স্বাক্ষর করবে। রাজ্যের তরফে বিষয়টি পরিষ্কার না থাকায় ফের ই-মেল করে আন্দোলনকারীরা জানিয়ে দেন, তাঁদের সঙ্গে দু জন পেশাদার ট্রান্সক্রিপ্ট রাইটার নিয়ে যাচ্ছেন। দু পক্ষের ই-মেল চালাচালির পর এদিন সন্ধ্যা ৫টা ৫০ মিনিট নাগাদ স্বাস্থ্য ভবনের অবস্থান মঞ্চ থেকে রওনা দেন জুনিয়র চিকিৎসকদের প্রতিনিধি দল। যাওয়ার আগে জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্টের অন্যতম নেতা কিঞ্জল নন্দ অবস্থানরত চিকিৎসক ও জড়ো হওয়া বিশাল জনতার সামনে জানিয়ে যান, ‘‘ ওখানে যে আলোচনাই হোক না কেন, সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এখানে এসেই।’’
 

Comments :0

Login to leave a comment