ডাক্তারি পাঠক্রমে ভর্তিতে দুর্নীতির মামলায় দুই বিচারপতির মধ্যে মতান্তরের পরেও সিবিআই তদন্ত বহাল থাকল। সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়েছে তদন্তের। বৃহস্পতিবার দু’মাসের মধ্যে সিবিআই’কে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। ডাক্তারি পাঠক্রমে সংরক্ষিত আসনে ছাত্রভর্তি নিয়ে অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। সংরক্ষিত আসনে ভুয়ো শংসাপত্র দিয়ে ভর্তির কথা স্বীকার করেছে কর্তৃপক্ষ। সেই মামলায় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সিবিআই তদন্তের নির্দেশের উপর বুধবার মৌখিকভাবে স্থগিতাদেশ দিয়েছিল বিচারপতি সৌমেন সেনের ডিভিসন বেঞ্চ। বৃহস্পতিবার বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় ডিভিসন বেঞ্চের এই মৌখিক স্থগিতাদেশকে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ বলে অভিহিত করেছেন। এদিকে, দুই বিচারপতির বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার রাতেই বিচারপতি সৌমেন সেনের ডিভিসন বেঞ্চ থেকে শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্ত মামলা সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। প্রধান বিচারপতি এই নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, বিচারপতি সৌমেন সেনের ডিভিসন বেঞ্চ শিক্ষা সংক্রান্ত মামলাগুলির শুক্রবার থেকেই বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর ডিভিসন বেঞ্চে পর্যায়ক্রমে শুনানি হবে।
এদিন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, বিচারপতি সেন একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে পক্ষপাতিত্ব করে তাঁর নির্দেশ দিয়েছেন। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এদিন তাঁর নির্দেশে সিবিআই তদন্ত বহাল রেখেছেন। সেই সঙ্গেই তিনি জানিয়েছেন, বিচারপতি সৌমেন সেনের বিরুদ্ধে কেন ইম্পিচমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু হবে না, তা সুপ্রিম কোর্টের কাছে জানতে চাওয়া হবে।
ডাক্তারি পাঠক্রমে বা মেডিক্যালে ছাত্রভর্তিতে সংরক্ষিত আসনে বেআইনিভাবে ভর্তির মামলায় দুই বিচারপতির মতান্তর বুধবারই শুরু হয়েছিল। বুধবার বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশের উপর মৌখিকভাবে স্থগিতাদেশ জারি করেছিল বিচারপতি সৌমেন সেনের ডিভিসন বেঞ্চ। এই সিবিআই তদন্তে স্থগিতাদেশের নির্দেশ দেওয়া হলেও এফআইআর দায়েরের নির্দেশের উপর ডিভিসন বেঞ্চের স্থগিতাদেশ ছিল না। বৃহস্পতিবার ডিভিসন বেঞ্চ জানায়, এই মামলায় কোনও এফআইআর’ও দায়ের করা যাবে না। সিবিআই আদালত থেকে যে সমস্ত নথি নিয়ে গিয়েছে, তা সব আদালতে ফিরিয়ে দিতে হবে।
এদিন মামলার শুনানির সময়ে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় রাজ্যের এজিকে (অ্যাটর্নি জেনারেল) জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘সিঙ্গল বেঞ্চের নির্দেশের কোনও বয়ান (কপি) ছাড়া ডিভিসন বেঞ্চ কী করে স্থগিতাদেশের নির্দেশ দেয়? এর আগে এমন কোনও নজির থাকলে তা আমাকে দেখান। এটা হয় না। একটা নির্দেশ না দেখেই তার উপর স্থগিতাদেশ হয় কী করে!’’ এজি জানান, ডিভিসন বেঞ্চের এই ক্ষমতা আছে। আদালত এজি-কে বলে, একটি উপযুক্ত আবেদন ছাড়া একটি নির্দেশের উপর কীভাবে বিচার করে ডিভিসন বেঞ্চ। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, কোনও নিয়ম না থাকলে ডিভিসন বেঞ্চ এমনভাবে বিচার করতে পারে না। নিশ্চয়ই কোনও নিয়ম আছে। সেই নিয়ম তাঁকে দেখানো হোক। প্রসঙ্গত, বুধবার বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশের পর আধ ঘণ্টার মধ্যে বিচারপতি সৌমেন সেনের ডিভিসন বেঞ্চ মৌখিকভাবে স্থগিতাদেশ জারি করেছিল। যা মৌখিক ছিল, বৃহস্পতিবার রাতে তা ডিভিসন বেঞ্চের লিখিত নির্দেশ হিসাবে হাইকোর্টের ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়েছে।
এদিন এজলাসেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় মন্তব্য করেন, বিচারপতি সেন একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে পক্ষপাতিত্ব করছেন। এই মামলায় রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকা ব্যক্তির মতো আচরণ করছেন। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অকাজ-কুকাজ থেকে অব্যাহতি দিতে চাইছেন। এরপরই বিচারপতি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে। বিচারপতি সেন তাঁর চেম্বারে বিচারপতি অমৃতা সিনহাকে ডেকেছিলেন। তিনি বিচারপতি সিনহাকে বলেছিলেন, অভিষেক ব্যানার্জির একটা রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ রয়েছে। তাঁকে বিরক্ত করবেন না। বিচারপতি সেন বিচারপতি সিনহাকে আরও বলেছিলেন, ‘‘আপনার এজলাসে (অমৃতা সিনহা) লাইভ স্ট্রিমিং (শুনানির সরাসরি সম্প্রচার) বন্ধ করতে হবে।’’ তিনি আরও বলেছেন, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের দু’টি মামলা খারিজ করে দিতে হবে। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, বিচারপতি সিনহা এই ঘটনার কথা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, বিচারপতি অমৃতা সিনহার নির্দেশেই শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির মামলায় অভিষেক ব্যানার্জির কোম্পানি লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের সম্পত্তির হিসাব ইডি’র হাতে জমা দিতে হয়েছে। বিচারপতি সিনহার নির্দেশেই ইডি অভিষেক ব্যানার্জির কোম্পানির ডিরেক্টর সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠস্বরের নমুনা সংগ্রহ করতে পেরেছে। এখন প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির বেশ কিছু মামলা বিচারপতি সিনহার হাতেই রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই বিচারপতি সিনহা এই মামলা শুনছেন। নির্দেশনামায় না থাকলেও বড়দিনের ছুটির আগে বিচারপতি সেন নিজের চেম্বারে বিচারপতি সিনহাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, তা আইনজীবীরাও জানতে পেরেছেন।
এদিন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় আরও বলেছেন, বেশ কিছু দিন আগে বিচারপতি সৌমেন সেনের বদলির নির্দেশ হয়েছে। সেই নির্দেশ বিচারপতি সেন মানেননি। এই বদলির নির্দেশের পরেও তার উপর কার হাত রয়েছে, তা দেখতে হবে। প্রসঙ্গত, সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর দেশের ১৭ জন বিচারপতিকে বিভিন্ন হাইকোর্টে বদলির সুপারিশ করেছিল। এর মধ্যে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সৌমেন সেনকে ওড়িশা হাইকোর্টে এবং বিচারপতি অরিন্দম সিনহাকে ওড়িশা হাইকোর্টে বদলির কথা বলা হয়েছিল। সেই ১৬ সেপ্টেম্বরের বদলির সুপারিশেই বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম মাদ্রাজ হাইকোর্ট থেকে কলকাতা হাইকোর্টে এসেছিলেন।
প্রসঙ্গত, মেডিক্যাল সংরক্ষিত আসনে ছাত্রভর্তির এই বেনিয়মের মামলাটি প্রায় এক বছরের পুরানো। জনৈক ঈশিতা সোরেন আদালতে অভিযোগ করেছিলেন, রাজ্যের সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলিতে সংরক্ষিত আসনে ভুয়ো শংসাপত্র জমা দিয়ে বেশ কয়েক জন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয়েছে। মামলার আবেদনকারী এই রকম ৫০টি নামের তালিকা তাঁর আবেদনের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় আগেই নির্দেশ দিয়েছিলেন, ডাক্তারির এই ৫০ জন শিক্ষার্থীকে মামলার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। শুনানি চলাকালীন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় নির্দেশ দিয়েছিলেন, নিয়মবিধি মেনে সংরক্ষিত আসনে ভর্তি নেওয়া হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, এসএসকেএম, এন আর এস এবং আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পাঠক্রমে সংরক্ষিত আসনে ভর্তিতে এই বেনিয়ম হয়েছে বলে মামলাকারী জানিয়েছিলেন। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এই মামলায় আগেই নির্দেশ দিয়েছিলেন, এই ৫০ জনের শংসাপত্র পরীক্ষা করে দেখতে হবে। তার রিপোর্ট আদালতে জমা দিতে হবে। গত ১৪ ডিসেম্বর রাজ্য সরকারের তরফে আদালতে সেই রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছিল। তাতেই স্বীকার করা হয়েছে, ১৪টি ক্ষেত্রে ভুয়ো শংসাপত্রের হদিশ পাওয়া গিয়েছে। অর্থাৎ ৫০ জনের মধ্যে ১৪ জনের শংসাপত্র ভুয়ো বলে আদালতকে জানানো হয়েছিল।
বুধবার এই মামলার শুনানিতে এজি কিশোর দত্ত জানিয়েছিলেন, সংশ্লিষ্ট দপ্তর এই বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রেখে ব্যবস্থা নেবে। এজি’র এই বক্তব্যের পরই আদালত বলে, ডাক্তারিতে ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রে আর্থিক অনিয়ম হয়েছে কি না, তা জানা প্রয়োজন। বিষয়টি রাজ্য সরকারের অনেক আগেই তদন্ত করে জানা উচিত ছিল। এরপর বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় মন্তব্য করেন, রাজ্য পুলিশের উপর তাঁর কোনও ভরসা নেই। এই মেডিক্যালে ছাত্র ভর্তির তদন্ত করবে সিবিআই। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় সিবিআই-কে এফআইআর দায়ের করে তদন্ত শুরু করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশের উপরেই আধ ঘণ্টার মধ্যে ডিভিসন বেঞ্চের মৌখিক স্থগিতাদেশের ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন এজি।
Comments :0