প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্নের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ এবং ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এ জল ঢেলে দিলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের প্রধান উপদেষ্টা এবং অতি ঘনিষ্ট বিশ্বের এক নম্বর ধনকুবের এলন মাস্ক। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইলেক্ট্রিক গাড়ি (ইভি) নির্মাতা টেসলা কোম্পানির মালিক মাস্কের পথ চেয়ে এক বছরের বেশি সময় অপেক্ষা করেছিলেন মোদীরা। আশায় বুক বেঁধে ছিল আমেরিকা-চীন বাণিজ্য যুদ্ধের মধ্যে মাস্কের হাত ধরে শিকে ছিঁড়বে ভারতের পক্ষে। কী ভাবে?
টেসলা বিশ্বের সর্বাধিক ইভি নির্মাণ করে। আন্তর্জাতিক ইভি’র বাজারের সর্বাধিক দখলও টেসলার। আর এই ইভি উৎপাদন টেসলা করে তাদের চীনের কারখানায়, চীনের বাজারেও তাদের দখলদারি। চীন-আমেরিকা বাণিজ্য যুদ্ধের জেরে টেসলার পক্ষে চীনের কারখানা থেকে গাড়ি তৈরি করে অন্যত্র বিক্রি করা কার্যত অসম্ভব হয়ে গেছে। তাই চীন থেকে উৎপাদন কেন্দ্র অন্য দেশে সরিয়ে নিয়ে যাবার বিকল্প ভাবনা শুরু হয়েছে। এই পর্বে ভারত জোর চেষ্টা শুরু করে টেসলাকে ভারতে আনার। এলন মাস্কের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ, আলোচনা করে তাকে রাজি করানোর জন্য মোদী নিজে একাধিকবার তার সাথে দেখা করেন। অর্থমন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রীরাও বিভিন্ন সময় একাধিকবার দেখা করেন টেসলাকে যেভাবেই হোক ভারতে আনার জন্য। টেসলা যদি ভারতে আসে তাহলে ভারতের মর্যাদা বেড়ে যাবে। মোদীর ছাতি আরও ফুলবে। তাই তিনি চেষ্টার কোনও কসুর করেননি।
ভারতকে বিশ্বের ইভি হাব বানানোর জন্য প্রচারের সূত্রপাত দেড় বছর আগে থেকে। গত লোকসভা নির্বাচনের আগে গতবছর ১৫ মার্চ ঘোষণা করা হয় ভারতের ইভি উৎপাদন নীতি। তখন থেকেই মাথায় চেপে বসেছে টেসলা। ট্রাম্পের মতো মাস্কও ভারতের শুল্ক নীতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, ভারতে তাদের ইলেক্ট্রিক গাড়ি বিক্রি করতে ১১০ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। এই অবস্থায় মাস্ককে খুশি করতে উঠে পড়ে লাগে মোদী সরকার। ইভি উৎপাদন নীতি ঘোষিত হলেও তার বিস্তারিত নিয়ম কানুন অঘোষিত থাকে। বাণিজ্য মহলে শোনা যায় মাস্কের সঙ্গে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে বিধি পরিবর্তন করে পরে প্রকাশ হবে।
ইভি’কে কেন্দ্র করে বড়সড় নির্বাচনী অ্যাজেন্ডা তৈরি করে ফেলেন মোদীরা। হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন আগামী দিনে ভারত হবে বিশ্বের ইভি উৎপাদন কেন্দ্র। সেটা হতে চলেছে টেসলার মালিক এলন মাস্কের হাত ধরে। নির্বাচনে প্রচার পর্বেই জানা গিয়েছিল মাস্কের সম্ভাব্য ভারত সফরের কথা। এটাও প্রচার হয় টেসলার ইভি নির্মাণের জন্য ভারতে ২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবেন মাস্ক। সেটাই ভারত সফরে এসে নিজের মুখে বলে যাবেন। মোদীর জয়জয়কার হবে। কয়েকদিন পরেই দুঃসংবাদ আসে মাস্ক প্রচণ্ড কাজের চাপে আসার সময় পাচ্ছেন না। অবশ্য দু’দিন বাদেই তিনি চীন সফরে চলে যান এবং সেখানে কয়েকদিন কাটান।
গত ফেব্রুয়ারিতে মোদী ওয়াশিংটনে মাস্কের সঙ্গে বৈঠক করেন। তার কয়েকদিন পরেই চমক। টেসলা তাদের ব্যবসা প্রসারের লক্ষ্যে ভারতে ১৩টি নতুন পদে কর্মী নিয়োগ করতে চলেছে। মুম্বাই ও দিল্লিতে দু’টি শোরুম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারপরই ট্রাম্পের ক্ষোভ। বুঝিয়ে দেন ভারতে টেসলার কারখানা বানানো তিনি মোটেই ভালো চোখে দেখছেন না। সেটা হবে আমেরিকার স্বার্থের পরিপন্থী। মহা সঙ্কটে পড়েন মাস্ক। এদিকে বিওয়াইডি সহ চীনের ইভি নির্মাতা সংস্থার সঙ্গে ঘোরতর আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে টেসলা। তাদের বিশ্ব উৎপাদন ১৬ শতাংশ কমে গেছে। গাড়ি সরবরাহ কমেছে ১৩ শতাংশ। জানুয়ারি-মার্চ’২৫ ত্রৈমাসিকে মুনাফা কমেছে ৭১ শতাংশ। টেসলাকে ডিঙিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম ইভি উৎপাদক হয়ে উঠেছে চীনের বিওয়াইডি। অন্য চীনা সংস্থাও টেসলার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। এরপর মাস্কের পক্ষে মোদীর জন্য ভারতে অভিসারে যাওয়ার প্রশ্নই উঠছে না।
editorial
মোদীর স্বপ্নে জল ঢাললেন মাস্ক

×
Comments :0