Saline Scam

তৃণমূল সরকারের আসার পরেই জন্ম প্রতারক স্যালাইন সংস্থার

রাজ্য

- ফারিস্তা বাণিজ্য প্রাইভেট লিমিটেডের অধীনে একটি সংস্থা হলো এই ‘পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যালস’ সংস্থাটি। তৃণমূল সরকারে আসার পরে ২০১৪ সালে এটি তৈরি হয়। উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ার তিনমাইলহাটে সংস্থাটির কারখানা। অফিস শিলিগুড়ি শহরের বর্ধমান রোডে।
বিষাক্ত স্যালাইনে প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনায় গোটা রাজ্য তোলপাড়। সরকারি হাসপাতালে রমরিময়ে চলছে ইতিমধ্যেই দক্ষিণ ভারতে চারজন প্রসূতির মৃত্যুর জন্য দায়ী ‘রিঙ্গার্স ল্যাকটেট’ (স্যালাইন)। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এই ভেজাল স্যালাইনে প্রসূতির মৃত্যু সহ একাধিকজনের গুরুতর অসুস্থ হয়ে যাওয়ার ঘটনার পরেও রাজ্যের সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল এসএসকেএম থেকে ডায়মন্ড হারবার মহকুমা হাসপাতালে শনিবারও এই স্যালাইন ব্যবহারের ছবি সামনে এসেছে।
রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রশাসন এখন হাত তুলে দিয়ে দাবি করছে ডিসেম্বর মাসেই সংস্থাকে উৎপাদন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গত ৭ জানুয়ারিও ফের এক দফায় নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রাজ্যর স্বাস্থ্য প্রশাসনের এমন দাবিতে আরও স্পষ্ট ‘ভূত’ আছে সর্ষের মধ্যেই। 
কেন? গত নভেম্বর মাসে কর্নাটকের বেল্লারি জেলা হাসপাতালে পাঁচ প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনার পরে ডিসেম্বর মাসে কর্নাটক সরকার কালো তালিকাভুক্ত করেছিল শিলিগুড়ির এই সংস্থাকে। রাজীব গান্ধী স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চিকিৎসকে নিয়ে তৈরি বিশেষজ্ঞ কমিটিও রিপোর্ট দিয়েছিল নিম্নমানের, বিষাক্ত এই স্যালাইন ব্যবহার করার ফলশ্রুতিতেই এই ঘটনা। এরপরেই কর্নাটক সরকারের তরফে ড্রাগস কন্ট্রোলার জেনারেল ওফ ইন্ডিয়া(ডিসিজিআই)’র কাছে চিঠি পাঠানো হয়। কীভাবে কলকাতায় অবস্থিত সেন্ট্রাল ড্রাগস ল্যাবরেটরি পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যালসের মতো সংস্থাকে স্ট্যান্ডার্ড কোয়ালিটি শংসাপত্র দিয়েছিল তার জবাব তলব করা হয়। তার ভিত্তিতেই সংস্থার উৎপাদন বন্ধের নির্দেশও দেওয়া হয়।
আর এখানেই উঠছে প্রশ্ন। এই ঘটনা পরম্পরাতেই  গত ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন(সিডিএসসিও) আর রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তর যৌথভাবে তদন্তে নেমে চোপড়ায় এই সংস্থার কারখানায় যায়। তল্লাশি চালায়। সমস্ত কিছু খতিয়ে দেখে যৌথ তদন্তকারী দল। রাজ্যের সরকারের তরফে স্পষ্ট জানানো হয় সেই সময় যে বিজ্ঞপ্তি জারি করে এই সংস্থার কারখানায় আইভি ফ্লুইড উৎপাদন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যা উৎপাদন হয়েছে তা যে গুদামে ফেলে রাখা হবেনা না নষ্ট করে দেওয়া হবে না, বরং অন্যত্র তা সরবরাহ করা হতে পারে সেই শঙ্কাও তো রয়েছে। রাজ্য সরকার তখন সিডিএসসিও’র কাছে জানায় আমরা সম্পূর্ণ নজরদারি রেখেছি। ড্রাগস কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্ট পুরোদস্তুর নজর রাখছে যাতে এই ‘রিঙ্গার্স ল্যাকটেট ’ (স্যালাইন) অন্যত্র কোথাও সরবরাহ না হতে পারে!
অথচ তার একমাস বাদেই দেখা গেল মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ থেকে শুরু করে রাজ্যের একাধিক সরকারি হাসপাতালে বেমালুম চলছে এই স্যালাইনের ব্যবহার যার জেরে ইতিমধ্যে একজন প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে, আরও একজন সঙ্কটজনক। তাহলে কোথায় নজরদারি?  নিষেধাজ্ঞা জারির পরেও ইতিমধ্যেই উৎপাদিত এই বিষাক্ত স্যালাইন কীভাবে পৌঁছালো সরকারি হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে? কাদের মাধ্যমে সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করা হলো এই ভেজাল স্যালাইন? কোথা থেকে টেন্ডার হলো? কাদের মাধ্যমে পাশ হলো? বিনিময় মূল্য কী ছিল?
আর জি করের দুর্নীতি, ভেজাল ওষুধ, মেয়াদ উত্তীর্ণ অস্ত্রোপচারের সরঞ্জামের কারবার আসলে ছিল হিমশৈলীর চূড়া মাত্র। কীভাবে কালো তালিকাভুক্ত একটি সংস্থা তারপরেও তাদের সামগ্রী সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করতে পারছে? রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলের ভূমিকা কী? রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিবকে অজ্ঞাত রেখেই কী কারবার চলছিল? রাজ্যের স্বাস্থ্য মন্ত্রীর কোনও প্রতিক্রিয়া ৪৮ ঘণ্টা পরেও মেলেনি। কেন? কী আড়াল করতে?
ফারিস্তা বাণিজ্য প্রাইভেট লিমিটেডের অধীনের একটি সংস্থা হলো এই ‘পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যালস’। ফারিস্তা বাণিজ্য প্রাইভেট লিমিটেডের বোর্ড অফ ডিরেক্টরসে আপাতত চারজন রয়েছেন। কৈলাস কুমার মিতরূকা, মুকুল ঘোষ, নীরাজ মিত্তাল এবং শিবকুমার গুপ্তা। আরওসি’র তালিকায় দেখা যাচ্ছে এই চারজনই ২০১১ সালের পরে বোর্ড অফ ডিরেক্টরসে এসেছিলেন। এদের মধ্যে দু’জনের সঙ্গে রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রশাসনের একটি প্রভাবশালী মহলের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র ঘনিষ্ঠতা বা শীলমোহর ছাড়া উত্তর দিনাজপুরের একটি কারখানা থেকে উৎপাদিত আইভি ফ্লুইড কলকাতা সহ রাজ্যের বড় বড় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলিতে চলতে পারতো না বলেই দাবি স্বাস্থ্য ভবনের একাংশের। শুধু তাই সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন(সিডিএসসিও)’র কাছেও সরকারের তরফে এই সংস্থা দীর্ঘদিনের, সুপরিচিত, স্ট্যান্ডার্ড সার্টিফিকেট রয়েছে বলেও তদ্বির করা হয়েছিল। কেন? কালো তালিকাভুক্ত, মানুষ মারা এই ভেজাল স্যালাইন কীসের ভিত্তিতে সরকারি হাসপাতালের চৌকাঠ পেরোতে পেরেছিল? 
সরকার চুপ। উত্তর হয়তো গত আগস্ট মাসেই দিয়ে গেছে আর জি করের ধর্ষণের পরে খুন হওয়া পড়ুয়া চিকিৎসক। 
আর জি করে দুর্নীতির তালিকায় কী ছিল না? চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনা থেকে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ, বিভিন্ন টেন্ডার ডেকে নিজের প্রভাব খাটানো, কোটি টাকার কমিশন খাওয়ার অভিযোগ বার বারে উঠেছে। কমিশনের ভিত্তিতে হাসপাতালের যাবতীয় কাজে টেন্ডার দেওয়া হয় নির্দিষ্ট সরবরাহকারীদের। খোদ অধ্যক্ষ প্রতিটি ক্ষেত্রেই অন্তত ২০ শতাংশ করে কাটমানি নেয়। বছরের পর বছর চুপ ছিল সরকার, প্রশাসন। আর জি কর হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা বর্জ্য কোটি-কোটি টাকায় এমনকি বাংলাদেশের বাজারে পাচার করা হচ্ছিল- এমন মারাত্মক অভিযোগও।  

 

Comments :0

Login to leave a comment