লিবিয়ার প্রাক্তন শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফি কে ক্ষমতা থেকে সরানো মস্ত বড় ভুল ছিল। গাদ্দাফির মৃত্যুর ফলে গোটা লিবিয়া বিশৃঙ্খলা এবং সংঘর্ষের আবর্তে প্রবেশ করেছে। বুধবার এমনই চাঞ্চল্যকর দাবি করলেন ইতালির বিদেশ মন্ত্রী অ্যান্টোনিও টাজানি।
বুধবার ইতালির টাসকানির একটি সভায় বক্তব্য রাখেন টাজানি। সেখানে সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, উত্তরসূরিদের তুলনায় গাদ্দাফি দক্ষ প্রশাসক ছিলেন।
তিনি আরও বলেছেন, গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচুৎ এবং হত্যা করা আমাদের তরফে মস্ত বড় ভুল ছিল। গাদ্দাফি লিবিয়াকে শৃঙ্খলার সুতোয় বাঁধতে পেরেছিল। তাঁর মৃত্যুর পরে শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এবং সেই শূন্যতা থেকে জন্ম নেওয়া বিশৃঙ্খলা লিবিয়া সহ গোটা উত্তর আফ্রিকাকে গ্রাস করেছে।
তিনি জানিয়েছেন, গাদ্দাফির সঙ্গে ইতালির একটি চুক্তি ছিল। সেই চুক্তির ফলে লিবিয়া থেকে সমুদ্রপথে ইতালিতে প্রবেশ করতে চাওয়া অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বহুলাংশে রোখা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু গাদ্দাফি পরবর্তী সময়ে লিবিয়া বিশৃঙ্খলায় ডুবে যায়। তারফলে সেই চুক্তিকে মান্যতা দেওয়ার মতো কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই। সেই সুযোগে প্রতিদিন বাড়ছে বেআইনি অনুপ্রবেশ। ঘটছে সমুদ্রে নৌকাডুবি হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও।
প্রসঙ্গত ২০১১ সালে লিবিয়ায় গণতন্ত্র ফেরানোর অভিযানের নামে ন্যাটো। নেতৃত্ব দেয় আমেরিকা। এই সামরিক অভিযানে ইতালিও সক্রিয় ভাবে অংশ নেয়। লিবিয়ার উপর ‘নো ফ্লায়িং জোন’ বলবৎ করার নামে বোমাবাজি চালায় পশ্চিমী এই সামরিক জোটের বায়ু সেনা। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় লিবিয়াকে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেই সময় লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছিল। গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করার লড়াই চালাচ্ছিলেন ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীরা। গণতন্ত্র ফেরানোর নামে সেই বাহিনীকেই সাহায্য করে ন্যাটো।
ন্যাটোর হামলায় পরাস্ত হয় লিবিয়ার সেনাবাহিনী। সেই সুযোগে বিদ্রোহীরা গাদ্দাফিকে হত্যা করে। পরবর্তীকালে সংযুক্ত রাষ্ট্র বা ইউকের সংসদের নিম্নকক্ষে এই সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট পেশ হয়। রিপোর্টে বলা হয়, লিবিয়ার গণতন্ত্রহীনতার খবর ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করা হয়েছিল। তাঁরাও গাদ্দাফি হত্যার বিরোধীতা করেছিল।
গাদ্দাফির মৃত্যুর পরে লিবিয়াকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী । ২০১১ সাল থেকে এখনো অবধি সেই গৃহযুদ্ধ চলছে। বর্তমান সময়ে লিবিয়ার লড়াই চলছে মূলত দুটি শক্তির মধ্যে। একদিকে রয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের মদতপুষ্ঠ গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল অ্যাকর্ড। অপরদিকে রয়েছে লিবিয়ার সংসদ। এই সংসদীয় বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেনারেল খালিফা হাফতার।
গাদ্দাফির মৃত্যুর পরে উত্তর আফ্রিকা জুড়ে সন্ত্রাসবাদ নতুন করে মাথাচাড়া দেয়। লিবিয়ার সহ প্রতিবেশী দেশ গুলিতে ঘাঁটি তৈরি করে ইসলামিক স্টেট এবং আল কায়দার সহযোগী গোষ্ঠীগুলি।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের একটি মহলের মতে, আফ্রিকায় ডলারের পরিবর্তে নতুন একটি বৈদেশিক মুদ্রা চালু করার চেষ্টা করছিলেন গাদ্দাফি। সেই চেষ্টা বানচাল করতেই লিবিয়ায় হামলা চালায় আমেরিকা এবং সহযোগী দেশগুলি। আরব দুনিয়ায় যাঁরা যাঁরা পশ্চিমী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছিলেন, তাঁদের অন্যতম ছিল মুয়াম্মার গাদ্দাফি। যদিও লিবিয়ার আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তাঁর বেশ কিছু নীতি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, লিবিয়ার মতো ইরাক সহ আরব দুনিয়ার বহু দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে আমেরিকা এবং ন্যাটো। এই হস্তক্ষেপের ফলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দূরের কথা, দেশগুলি ডুবে গিয়েছে অরাজকতায়। ভেঙে পড়েছে অর্থনীতি। আকাশ ছুঁয়েছে বেকারত্ব। একপ্রকার বাধ্য হয়েই এই দেশগুলির সাধারণ মানুষ কর্মসংস্থানের খোঁজে পাড়ি দিচ্ছে ইউরোপে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেআইনি ভাবে। এরফলে ইউরোপে তৈরি হচ্ছে সস্তা শ্রমের বাজার। এবং এই শ্রমিকদের নেই ন্যূনতম কোনও সামাজিক সুরক্ষা।
২০১৪ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, সেই সময় লিবিয়ায় ১৬০০’র বেশি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী সক্রিয় ছিল। ইউএস ইন্সটিটিউট অফ পিসের তরফে প্রকাশিত সেই রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১১ সালে এমন গোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০০।
বর্তমানে লিবিয়ার দুই গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াই কিছুটা স্তীমিত হলেও হিংসার ঘটনার কোন বিরাম নেই। চলতি সপ্তাহেই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির সংঘর্ষে ২৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহতের সংখ্যা একশোর বেশি।
Comments :0