দেবেশ দাস
বিজেপি সরকার দীর্ঘদিন ধরেই এক দেশ এক আইনের কথা বলে আসছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই অভিন্ন দেওয়ানি আইন নেই। কোনও এক ধর্মের মানুষের জন্য আইনে যা থাকে, তাতে সাধারণত সেই ধর্ম অনুসারী নারী ও পুরুষের অধিকারে ফারাক দেখা যায়। কিন্তু তাতে এ কথা বলা চলে না যে তার ফলে অন্য ধর্মাবলম্বীরা বঞ্চিত হন।
কিন্তু আমাদের দেশে এমন কিছু আইন সরকারই তৈরি করেছে যাতে কোনও নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বী মানুষদের জন্য বঞ্চনা বা বাড়তি সুবিধা করে দেওয়া আছে। আবার এমনও নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বী মানুষদের জন্য আইন সরকার বানিয়েছে যার জন্য সারা দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এগুলির কয়েকটি বিষয় এখানে বলা হলো। প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্র কেন ভিন্নতা চাপাবে?
(১) হিন্দু পরিবার আইন
ব্রিটিশ আমল থেকেই ১৯২২ সালে শুধু হিন্দুদের আয়কর কম দেওয়ার জন্য একটা আইন চালু হয়, যেখানে একটি অবিভক্ত হিন্দু পরিবার হিসাবে নথিভুক্ত করলে অনেক আয়কর কম দিতে হয়। এ আইন এখনো চালু আছে। এই সুযোগ অন্য ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে নেই। আপনি যদি অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে চান তবে আয়কর দপ্তরের ওয়েবসাইটে আপনি কী হিসাবে আয়করের রিটার্ন দাখিল করতে চান আপনি তাতে তিনটি অপশন পাবেন— একক ব্যক্তি, হিন্দু অবিভক্ত পরিবার, অন্যান্য। এই অন্যান্যদের মধ্যে আবার ৬টি ভাগ আছে (কোম্পানি, অ্যাসোসিয়েশন, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, ইত্যাদি), তবে কোনও ধর্মীয় ভাগ নয়।
অবিভক্ত হিন্দু পরিবার আইনে কতটা আয়কর কম দিতে হয়? একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। ধরা যাক কোনও চাকরিজীবি হিন্দুর বেতন বাবদ বছরে আয় ২০ লাখ টাকা ও সম্পত্তি ভাড়া দিয়ে আয় ৭.৫ লাখ টাকা, তাহলে তাঁকে ন্যূনতম আয়কর দিতে হবে বছরে ৫ লাখ ৪৬ হাজার টাকা, কিন্তু তিনি যদি অভিবক্ত হিন্দু পরিবারের সদস্য হিসাবে নথিভুক্ত করেন তবে তার আয়কর হবে ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৭০০ টাকা, মানে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৩০০ টাকা কম।
১৯৩৬ সালে আয়কর দপ্তরের তদন্ত রিপোর্ট এইভাবে সরকারি কোষাগারে কম আয়কর দেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেছিল; স্বাধীন ভারতে ১৯৫৩-৫৪ সালে কর আদায়ের জন্য গঠিত তদন্ত কমিশন অবিভিক্ত হিন্দু পরিবার নিয়ে কিছু অসঙ্গতির বিষয় বলেছিল, কিন্তু আর এগোয়নি; ১৯৭১ সালে প্রত্যক্ষ আয়কর তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে অবিভক্ত হিন্দু পরিবারের সুযোগ নিয়ে আয়কর এড়ানো হচ্ছে; আয়কর দপ্তরের প্রাক্তন প্রধান কমিশনার রামানুজন বলেছিলেন— "অবিভক্ত হিন্দু পরিবার আয়করদাতা হিন্দুর কাছে আশীর্বাদ হতে পারে, কিন্তু নিঃসন্দেহে এটা সরকারি রাজস্বের জন্য সর্বনাশ"। কিন্তু ব্রিটিশের সেই আয়কর আইন আজও চলছে।
বলা বাহুল্য হিন্দুদের মধ্যে যারা বেশি আয় করতেন (মূলত উচ্চবর্ণ), তাঁদের জন্যই এই আয়কর আইন ব্রিটিশরা চালু করেছিল। ২১তম আইন কমিশন এইভাবে শুধুমাত্র হিন্দুদের আয়কর ছাড় দেওয়াকে বলেছে ব্রিটিশের সামাজিক উপহার। শুধু হিন্দুদের জন্য আলাদা একটা আয়করের সুবিধা দেওয়া কী অভিন্ন আইন বিরোধী নয়? ব্রিটিশদের এই ঔপনিবেশিক আইন আজও চলবে কেন? যে অভিন্ন আইনের কথা সরকার এতদিন বলে আসছে, তাতে এই আইন বাতিলের কথা কোনোদিন বলা হয়নি। কিন্তু অভিন্নতার দিকে এগতে ২১তম আইন কমিশন কিছু আইনের সংস্কারের প্রস্তাব করেছিল, তাতে এই আইন বাতিলের কথা বলেছিল।
(২) নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, ২০১৯
এই আইনে যদি কেউ বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে ভারতে এসে থাকে ও তার ধর্ম হিন্দু বা শিখ বা বৌদ্ধ বা জৈন বা পারসি বা খ্রিস্টান হয়, তবে সে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী নয়। কিন্তু এরকম কোনও মুসলিম এলে সে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী। সংবিধানের ১৪ নং ধারায় আমরা বলেছি— “ভারতের সীমানার মধ্যে রাষ্ট্র কাউকে আইনের চোখে সমতা বা সমান আইনি সুরক্ষা দিতে অস্বীকার করবে না”। ফলে এক্ষেত্রে রাষ্ট্র সমস্ত ধর্মাবলম্বী মানুষদের অভিন্ন চোখে দেখছে না। এটা কি অভিন্ন আইন?
(৩) মুসলিম মহিলা আইন ১৯৮৬
১৯৮৫ সালে মধ্য প্রদেশে স্বামী পরিত্যক্তা শাহ বানো স্বামীর কাছে খোরপোষের জন্য আদালতে মামলা করে, স্বামী তাঁকে তাৎক্ষণিক তিন-তালাক দিয়ে ডিভোর্স দিয়ে দেন। মুসলিম আইনে ডিভোর্সে খোরপোশের ব্যাপার নেই। কিন্তু শাহ বানো ফৌজদারি প্রসিডিওর’র ১২৫ নং ধারায় মামলা করেন। মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ালে, সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে শাহ বানোকে খোরপোশ দিতে হবে স্বামীকে। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় অবশ্যই অভিন্ন দেওয়ানি আইনের পক্ষে এক পদক্ষেপ। বামপন্থীরা এই রায় সমর্থন করেছিল।
সেই রায়ের পর ১৯৮৬ সালে রাজীব গান্ধী সরকার একটি নতুন আইন আনেন যেখানে স্বামীকে এই খোরপোশ দিতে হবে না। বামপন্থীরা এই আইনের বিরোধিতা করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই এই আইন আনার অর্থ শুধুমাত্র মুসলিম মহিলাদের জন্য এই ধরনের খোরপোশ থেকে বঞ্চিত করা।
(৪) মুসলিম মহিলা আইন ২০১৯
২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট মুসলিমদের মধ্যে চালু তাৎক্ষণিক তিন-তালাক (তালাক-ই-বিদ্দত) খারিজ করে দেয়। কোন মামলায় এই রায়? সরকার কিন্তু এই মামলা করেনি। কিছু মুসলিম মহিলা ও মুসলিম মহিলাদের সংগঠন সরকারের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক তিন তালাকের দাবিতে মামলা করেছিল। মামলা চলাকালীন কিছু মুসলিম মহিলা সংগঠনের সুপ্রিম কোর্টে ধরনা দিতে দেখা গেছে, এমনকি সেই ধরনায় আসন্নপ্রসবা এক মুসলিম মহিলার ছবিও মিডিয়ায় এসেছিল।
২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের অর্থ ছিল যে যদি কোনও মুসলিম পুরুষ তার স্ত্রীকে পরপর তিন বার তালাক বলে তাঁকে ডিভোর্স দিতে চায়, তবে এই রায়ের পরে আর ডিভোর্স হবে না, স্ত্রী আগের মতোই সম্পূর্ণ অধিকার নিয়ে বহাল থাকবে। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে বামপন্থীরা সমর্থন করেছিল।
এরপর বিজেপি সরকার প্রথমে অর্ডিন্যান্স, পরে ২০১৯ সালে আইন করে, যে আইনে বলা হয় যে কোনও মুসলিম পুরুষ যদি তাঁর স্ত্রীকে তাৎক্ষণিক তিন-তালাক দেয়, তবে তাকে তিন বছরের জন্য জেলে ঢোকানো হবে।
সুপ্রিম কোর্ট পরপর তিনবার তালাক শব্দকে অর্থহীন করেছিল, মানে মুখে সেটা উচ্চারণ করাও যা, না করাও তা। কেন্দ্রীয় সরকারের আইনের পর এটা দাড়ালো যে সেই মহিলার আইনের সাহায্য নিতে আসলে আগে স্বামীর জেল হবে।
এখন কোনও হিন্দু পুরুষ তার স্ত্রীকে মুখে ডিভোর্সের কথা বললে কি তার জেল হয়? তাহলে একজন মুসলিম পুরুষ অর্থহীন তিন তালাক বললে তার জেল হবে কেন? শুধুমাত্র মুসলিমদের ক্ষেত্রে দেওয়ানি আইনকে ফৌজদারি আইনে পরিণত করা কেন?
তাৎক্ষণিক তিন-তালাক প্রাপ্ত স্ত্রী স্বামীকে জেলে পাঠাতে পারছে, কিন্তু কোনও অ-মুসলিম মহিলার মতো সম্পূর্ণ ভরণপোষণের দাবি করতে পারছে না। অ-মুসলিম নারীরা স্বামীর কাছে ভরণপোষণের দাবি করতে যে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে, তা থেকে মুসলিম নারীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। এটা অভিন্ন আইন? সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার তাৎক্ষণিক তিন-তালাকপ্রাপ্ত কোনও মহিলাকে তার অধিকার বজায় রাখার জন্য দরকার হলে তাকে দ্রুত আইনি সাহায্য দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারতো। তা তো করেইনি, বরং অ-মুসলিম মহিলাদের যে অধিকার আছে, তা থেকেও তাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
এক মুসলিম মহিলা একটি ইংরেজি সাময়িক পত্রের প্রতিবেদন উল্লেখ করে লিখেছেন— “এই আইনে বিপাকে পড়ছেন মেয়েরাই। হায়দরাবাদের বেশ কিছু মেয়ে জানিয়েছেন, তাঁরা শুধু আদালতে চক্কর কাটছেন। তিন তালাক দেওয়াতে স্বামীরা জেলে, তাতে মেয়েদের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। স্বামী তবু জেলে খাবার পাচ্ছে, মেয়েদের সন্তানদের নিয়ে অনাহারে মরতে হচ্ছে। মামলার খরচ চালাতে গিয়ে তাঁরা সর্বস্বান্ত। জেলায় জেলায় এখন মামলার পাহাড়” (খাদিজা বানু, 'অন্যরা পারে, ভারত পারে না', আনন্দবাজার পত্রিকা ২৬ অক্টোবর, ২০২২)। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বলেছে— "আইনটি মুসলিম নারীদের রক্ষা করার বিষয়টি দেখছে না, মুসলিম পুরুষদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করেছে। যদি অভিন্নতা থাকতো, তবে এটা গ্রহণযোগ্য হতো"। আর বাস্তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষের কিছুই হচ্ছে না, কারণ মহিলারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুলিশের কাছে যায় না, কারণ গেলে স্বামীর জেল হবে, কিন্তু তার ভরণপোষণে কোনও সুবিধা হবে না। বিবিসি কর্তৃক একটি সংবাদে প্রকাশ যে এই আইনের পরে দেখা যাচ্ছে তাৎক্ষণিক তিন-তালাক দেওয়া আরও বেড়ে গেছে।
সরকার অভিন্নতা চায় না— আরেকটি উদাহরণ
আরেকটি ক্ষেত্রে আইন এখনো হয়নি, তবে সরকারের মতামত অভিন্নতার বিপক্ষে। সামাজিক ও শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে পড়া তফসিলি জাতি ও তফসিলি জনজাতিদের জন্য চাকরি ও শিক্ষাক্ষেত্রে সংরক্ষণ সংবিধানে দেওয়া আছে। কারা কতটা সামাজিক ও শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে আছে, তা ঠিক করার জন্য সরকারি নিয়মকানুন আছে। সরকার হলফনামা দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের কাছে বলেছে তফসিলি জাতি ও তফসিলি জনজাতিদের কেউ হিন্দু ধর্ম বাদে অন্য ধর্ম গ্রহণ করলে তাঁর সংবিধান বর্ণিত সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়া উচিত। সব ধর্মকে এক্ষেত্রে এক দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে না।
উপসংহার
সারা দেশে অভিন্ন আইন আনা জরুরি কী জরুরি না, জরুরি হলে কী পরিবর্তন আনতে হবে আইনে, জরুরি না হলে এখনই কী কী আইনি সংস্কার করা প্রয়োজন তা নিয়ে নানা বিতর্ক, আলোচনা আছে। গণতান্ত্রিক পরিবেশে সে আলোচনা হওয়া দরকার। কিন্তু তার আগে সরকার কর্তৃক ধর্মের ভিত্তিতে চাপানো ভিন্নতাগুলি কেন বন্ধ করার কথা উঠবে না?
Comments :0