অনিন্দ্য হাজরা
গ্রামে কাজ নেই। পুরুষরা গ্রামের বাইরে না গেলে পেট চলবে কেমন করে?
রশিদা বেগম। রাইপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের নিয়ামতপুর গ্রামে সিপিআই(এম)'র হয়ে পঞ্চায়েত ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই ভোটেই বুথ আগলাতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন তাঁর দেওর রিন্টু শেখ।
পরিযায়ী শ্রমিক রিন্টু শেখ। চেন্নাইয়ে নির্মাণ শিল্পে কাজ করতেন। নিয়ামতপুরের বুথে তৃণমূলের ভোট লুট ঠেকাতে গিয়ে শহীদ।
রিন্টু শেখের মেজ দাদা নজরুল ইসলাম। কলকাতায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করেন। অপর এক ভাইও চেন্নাইয়ে পরিযায়ী শ্রমিক। নজরুল ইসলাম ভাইকে কোলে পিঠে মানুষ করেছিলেন। এখন বাপহারা ভাইপোকেও ছেলের মত সামলাচ্ছেন।
রিন্টুর ছেলে জসিমুদ্দিন ইসলাম স্থানীয় জিতারপুর বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র, আর মেয়ে আরিকা খাতুন ক্লাস টুয়েলভে আর্টস নিয়ে পড়ে।
নজরুলের কথায়, আমরা ভাইরা মিলে নতুন বাড়িটা বানাচ্ছিলাম। বাপ সেই কোনকালে চোখ বন্ধ করেছে। রিন্টু কিছু না হলেও মাসে ১০-১৫ হাজার টাকা বাড়ি পাঠাত। সব শেষ। এখন আমরা বাকিরা যতটা পারছি করছি।
মুর্শিদাবাদের রিন্টুরা পরিযায়ী হয় কেন? রশিদা বিবির কথায়, গ্রামে কাজ আছে নাকি?
রাইপুর পঞ্চায়েতের একরাম মিঞা। স্কুলের পাশে ছাওয়ায় খানিক জিরোচ্ছিলেন। মাথায় খড়ের টুপি। বৃদ্ধ কৃষকের কথায়, চাষের যা অবস্থা, তাতে ঘরের লোকেরা মাঠে হাত লাগালেও লাভ চোখে দেখা যায়না। সেচের দাম, সারের দাম ফি বছর বাড়ছে। তারপর খেতে শ্রমিক নামালে চাষির কিছুই থাকবে না। গ্রামে যত পাকা বাড়ি দেখছেন, সব হয় ২০১১ সালের আগে আবাসের টাকায় হয়েছে, নইলে বাইরের রাজ্য থেকে পাঠানো টাকায় হয়েছে।
ভিন রাজ্য থেকে রিন্টু শেখরা দিল্লি, চেন্নাইয়ে ঘাম ঝড়ায়, সেই পরিশ্রমেই কিছুটা হলে অবস্থা ফিরেছে রাজ্যের অন্যতম পিছিয়ে পড়া এই জেলার। আবার গণতন্ত্র রক্ষায় তারাই প্রাণ হারায়।
কিন্তু সরকার? তার ভূমিকা কোথায়?
সরকার আছে। আলাদা ভূমিকায়। যেমন গোটা হরিহরপাড়ায় কল আছে। কিন্তু জল নেই। এই আশ্চর্য কীর্তির মুখ্য কুশিলব সামসুজ্জোহা বিশ্বাস রাজু। মুর্শিদাবাদের জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ। হরিহরপাড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা আর্সেনিক কবলিত। পানীয় জলের সঙ্কট মেটাতে ২০১০ সাল নাগাদ হুমাইপুরে জল প্রকল্পের উদ্যোগ নেয় প্রশাসন। সেই প্রকল্প খাতায় কলমে শেষ হয় ২০২৩-২৪ আর্থিক বছরে। প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল হুমাইপুর, রাইপুর, খিদিরপুরের মত গ্রামগুলির। কিন্তু হয়নি৷
কারণ সামসুজ্জোহা বিশ্বাস কাটমানির হিসেব ঠিক রাখতে অপরিকল্পিত ভাবে প্রকল্প শেষ করিয়েছে বলে অভিযোগ। তারফল এই ভরা গ্রীষ্মেও মানুষকে জল কিনে খেতে হচ্ছে।
তৃণমূলকে অভিযোগ জানালেই বলা হচ্ছে, লক্ষীর ভান্ডার বন্ধ করে দেওয়া হবে বেশি কথা বললে। হুমাইপুরের প্রদীপ ডাঙার মহিলাদের অভিজ্ঞতা এমনই।
সরকার শুধু দুর্নীতির পথ সুগম করেছে এমনটা নয়। যুবদের নিয়োগ দিতে ব্যর্থ সরকার আড়ালের চেষ্টা করেছে খুনীদেরও।
পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন বুথ আগলাতে গিয়ে গুরুতর আহত হয় রিন্টু শেখ। বড়ঞা হাসপাতাল ঘুরে এনআরএস হাসপাতালে এসে ৭ দিন পরে প্রাণ হারান তিনি। সেই ঘটনায় আহত হয়েছিলেন আরও ৭ জন। নির্বাচনী সন্ত্রাসের মূল অভিযুক্ত হরিহরপাড়ার বিধায়ক নিয়ামৎ শেখের ছেলে জিল্লার রহমান। তিনি জেলা পরিষদের প্রার্থী ছিলেন। অভিযোগ, মুর্শিদাবাদের কয়লা ব্যবসা এবং ইট ভাটার গোটা নিয়ন্ত্রণ নিয়ামৎ-র। ছেলের নামে ভুয়ো কম্পানি খুলে জেলা প্রশাসনের টেন্ডারও নেন তিনি। রাজ্য ও জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের জন্য কাটা কয়েকশো বছরের প্রাচীন গাছ বিক্রির টাকাও টেন্ডার লুটে ঢুকেছে বিধায়কের পকেটে।
জিল্লার-নিয়ামৎ বাহিনী নিয়ামতপুর, মাদারতলা, সদানন্দপুরে তান্ডব চালায়। রিন্টু শেখকে খুনও করে ৪-৫টি স্করপিও চড়ে ঘুরে বেড়ানো এই বাহিনী। রিন্টুর পরিবার জিল্লার রহমান এবং নিয়ামৎ শেখের নামে অভিযোগ করলেও, রিন্টুর স্ত্রীকে সাদা কাগজে সই করিয়ে তাদের নাম এফআইআর থেকে বাদ দিয়েছে পুলিশ৷ ২২ জনের নামে এফআইআর হলেও সেখান থেকে আরও ৬জনের নাম বাদ পড়ে। উলটে সদানন্দপুরে প্রতিরোধ গড়ার প্রতিশোধ নিতে ৭২ জনের নামে মিথ্যা মামলা দায়ের হয়েছে।
কিন্তু এখানেই শেষ নয় কাহিনী। ২০১১ সালের নির্বাচনেও হরিহরপাড়ায় ৮৮,৫৯৪ ভোট পেয়েছিলেন বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী৷ সেই জনসমর্থনের আভাস মিলল বৃহস্পতিবার। এদিন কুমারদহ ঘাটের সামনে থেকে রোড শো হয় মহম্মদ সেলিমের।
সিপিআই(এম) বহড়ান এরিয়া কমিটির সম্পাদক আব্দুর রজ্জাকের সহাস্য মন্তব্য, "রোড শো'র জন্য আমরা হরিহরপাড়া আর বহড়ান এরিয়া কমিটির ১০টা অঞ্চল থেকে ২০টা করে বাইক আনতে বলেছিলাম। রোড শো শুরুর আগে কাচুমাচু মুখ করে এক কর্মী বললেন, বুথ থেকে ২৩টার বেশি বাইক আনতে পারিনি। আর্থিক ক্ষমতায় কুলোয়নি। আর্থিক সঙ্গতি থাকলে সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াত তাহলে ভাবুন।"
এদিন কুমারদহ ঘাট থেকে মামুদপুর অবধি ২০ কিলোমিটার পথ এই জনস্রোতকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলেন মহম্মদ সেলিম। জমায়েতের বাধ ভাঙা উচ্ছ্বাস এক সময় দখল নেয় বহরমপুর-আমতলা রাজ্য সড়কের গোটাটাই। রোড শো'তে মহম্মদ সেলিমের সঙ্গে ছিলেন জেএনইউ'র এসএফআই নেত্রী ঐষী ঘোষ, জামির মোল্লা, শেখ হাসিনা, ইনসার আলি বিশ্বাস, আব্দুর রাজ্জাক, সচ্চিদানন্দ কান্ডারি, সন্দীপন দাস প্রমুখ। ছিলেন কংগ্রেসের মোশারফ হোসেন, সফিকুল সেখ, বিজয় সেখ।
Comments :0