ভূমধ্যসাগরের বেলাভূমিতে ঠিক যেন পুতুলের মতো শুয়ে ছিল সে, প্রাণহীন। দু’বছরের আয়লান কুর্দির ছবি সাত বছর আগেই দেখেছে সারা বিশ্ব। সিরিয়া থেকে তার পরিবার তুরস্কের তট থেকে চলে যেতে চেয়েছিল ইউরোপে। ডুবে গিয়েছিল ছোট্ট মোটরবোট। মারা গিয়েছিলেন আয়লানের মা, তাঁর দাদাও।
বিশ্বকাপের জমাটিয়া আলো আঁধারিতেও কাতার কী মনে করাচ্ছে আয়লানকে? জমাট অন্ধকারে থেকে গিয়েছে ক্ষোভ। অভিবাসী শ্রমিকদের যন্ত্রণা। তাঁদের মৃত্যু। তাঁদের বাড়ি না ফিরতে দিয়ে মায়না আটকে রাখা। কোনও সুরক্ষা ছাড়া বিপজ্জনক কাজ করানো।
কানাডায় যেতে চেয়েছিল আয়লানের পরিবার। পৌঁছালে সেখানেও হয়ত একগুচ্ছ অবহেলা সয়েই দিন কাটত তার পরিবারের। সমালোচনা ঢাকতে ফিফার সভাপতি জিয়ান্নি ইনফ্যান্তিনো তো বলে ফেলেছেন, ‘‘অভিবাসী শ্রমিকদের অসুরক্ষা নিয়ে কেবল কাতারকেই কেন দায়ী করছে পশ্চিমী মিডিয়া। ইউরোপে কতটা সুরক্ষিত অভিবাসী শ্রমিকরা। সেখানে তাঁরা অবহেলার শিকার নন?’’
জিয়ান্নির সাফাইয়ে সঙ্গত দেওয়ার প্রশ্নই নেই। কাতারে বিশ্বকাপের অনুমতি নিয়ে সমালোচনার ঝড়, পেট্রোডলারের গোপন লেনদেনের অভিযোগ- সেসবে ঠিক-বেঠিক খুঁজে দেখা হয়নি। ইউরোপে হয় বলে কাতারেও হবে- এমন যুক্তিতেও সায় দেওয়ার প্রশ্ন নেই। কিন্তু অবধারিত এই যে বিশ্বের মিলনমেলাতেও এড়ানো যাচ্ছে না সেই সত্য, অসুরক্ষার গভীর বিষাদে শ্রমজীবীকে ঠেলে ফেলেই বেড়ে উঠছে মুনাফার তাজমহল। কাতার তার একটি নমুনা, অবহেলা করার প্রশ্নই নেই।
গত এক দশকে এবং তার পরেও হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে কাতারে। তার মধ্যে আছেন ভারতীয়েরা। আছেন নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষ, যাঁদের এক এবং একমাত্র সম্পদ শ্রম। অন্যদেশ থেকে এসেছেন, আইনি সুরক্ষা নেই প্রায়। ফলে তলানিতে সুরক্ষার ন্যূনতম শর্ত।
সংবাদমাধ্যমে বেরিয়ে পড়েছে, বিশ্বকাপের প্রস্তুতির কাজেই কাতারে মৃত শ্রমিকের সংখ্যা ৪০০ থেকে ৫০০! কাতার প্রশাসনে এক শীর্ষ কর্তা হাসান আল থাওয়াদি জানিয়েছেন যে, মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান এখনও ‘‘আলোচনাধীন’’। যদিও, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তিনি জানিয়েছেন, মৃত শ্রমিকের সংখ্যা ৪০০ হতে পারে। ব্রিটিশ গার্ডিয়ান পত্রিকার প্রতিবেদনে দাবি, ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ থেকে কাতারে আসা প্রায় ৬,৫০০ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে কাতারে। অ্যামনেস্টির মতে এই দশ বছরে অন্তত ১৭,০০০ পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে কাতারের কাজ করতে এসে।
ঘটনা হলো, ভারতের মতো এই দেশগুলি দ্বিপাক্ষিক স্তরে কাতার বা পশ্চিম এশিয়ার অন্য কোনও দেশের সঙ্গে শ্রমিকের সুরক্ষার বিষয়টি তোলে না। বিদেশি মুদ্রা দেশে আসে, চোখ বুঁজে ফেলে শ্রমজীবীদের নিজের নিজের দেশের সরকারও।
কাতারের অমানুষিক তাপপ্রবাহ স্বাস্থ্যের জন্য বিশাল ঝুঁকির। ওয়ার্ল্ড ট্র্যাভেল গাইড অনুসারে, কাতার একটি 'উপ-ক্রান্তীয় মরুভূমির জলবায়ু' অঞ্চল। জুন থেকে সেপ্টেম্বর প্রখর গরম। তার মধ্যেই দিনান্তে অমানুষিক শ্রম দিতে এক প্রকার বাধ্য করা হয় শ্রমিকদের। বিশ্বকাপ শুরুর এক মাস আগে পর্যন্তও শ্রমিকদের মানবাধিকার নিয়ে না ফিফা, না কাতার- কেউ কোনও ভূমিকা নেয়নি। অভিযোগ তুলছে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশেনাল (Amnesty International)। অ্যামনেস্টটি বলছে, বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু শ্রম আইন মানার পক্ষে চাপ রেখে দেওয়া জরুরি।
অ্যামনেস্টির প্রকাশ করেছে ‘অসমাপ্ত ব্যবসা: অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকারের প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য কাতারকে কী করতে হবে’ শীর্ষক প্রতিবেদন। বলা হয়েছে, ‘‘শ্রম সংস্কারের উদ্যোগ দোহা থেকে বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেলে থেমে যাওয়া উচিত নয়। কিক-অফের মাত্র এক মাস আগে অ্যামনেস্টি আবারও ফিফা এবং কাতারকে নিপীড়িত পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য একটি ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠনের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছে।’’
বিভিন্ন প্রকল্প জুড়েই হাজার হাজার শ্রমিক এখনও নিয়মিত মজুরি, বিশ্রামের দিন, অসুরক্ষিত কাজের পরিস্থিতি, কাজ পরিবর্তনে বাধা এবং ন্যায়বিচার না পাওয়ার মতো সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে হাজার হাজার শ্রমিককে। এখনও পর্যন্ত কয়েক হাজার শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনাও তদন্ত করা হয়নি। অনেক শ্রমিক, বিশেষ করে গৃহস্থালির কাজে এবং নিরাপত্তা পরিষেবার কাজে, এক প্রকার বাধ্যতামূলক শ্রমের শিকার হচ্ছেন। গৃহকর্মীরা এখনও সাপ্তাহিক কোনো ছুটি ছাড়াই দিনে ১৪ থেকে ১৮ ঘন্টা কাজ করতে বাধ্য হন।
গত মাসে, অ্যামনেস্টির করা একটি গ্লোবাল সমীক্ষায় দেখা গেছে বিশ্বকাপের প্রস্তুতির সময় ক্ষতিগ্রস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের জন্য সাধারণ জনগণ এবং ফুটবল ভক্ত উভয়ের সমর্থন রয়েছে প্রবলভাবে।
নিরাপত্তা রক্ষার সাথে যুক্ত শ্রমিকদের ছুটি তো অগ্রাহ্য করা হয়েই থাকে, উলটে, ছুটি চাইলে তাঁদের জরিমানা, বেতন কাটা এমকি পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করারও হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বারবার। এই ঘটনা কেবল ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের উপর বিধ্বংসী মানসিক প্রভাব ফেলে তাই নয়। আর্থিক ক্ষতিপূরণ না পাওয়া পরিবারের প্রধান উপার্জনকারীর মৃত্যু সেই পরিবারকে আরও গভীর দারিদ্র্যে ঠেলে দেয়। অ্যামনেস্টিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কাতারে মৃত এক শ্রমিকের স্ত্রী বলেছেন: ‘‘এখন সবকিছু ভেঙ্গে গেছে... জীবন নিজেই একটা ভাঙা আয়নার মত হয়ে গেছে... আবেগে কেঁদেছি বহুবার। একা থাকা খুব কঠিন … আমার মনে হচ্ছে আমি তেলে পুড়ে যাচ্ছি।’’
পরিযায়ী শ্রমিকরা কাতারে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন বা যোগদান করতে পারেন না। কুখ্যাত ‘কাফালা’ (Kafala system) ব্যবস্থার কোনো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করার উদ্যোগ নেই। এটি একটি এমন ব্যবস্থা যা শ্রমিকদের সম্পূর্ণরূপে তাদের নিয়োগকর্তার উপর নির্ভরশীল করে রাখে। এই ব্যবস্থা পরিযায়ী শ্রমিকদের এখনও গ্রেপ্তার বা নির্বাসনের ঝুঁকিতে রেখেছে। এই ব্যবস্থায় তাঁদের নিয়োগকর্তা ইচ্ছামতো তাদের ভিসা বাতিল করতে পারে, তাঁদের বসবাসের অনুমতি পুনর্নবীকরণ করতে অস্বীকার করে তাদের "পলাতক" হিসাবে রিপোর্ট করতে পারে। যদিও কাতার কর্তৃপক্ষ বলছে যে তারা ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে ৩০০,০০০ টিরও বেশি চাকরি পরিবর্তনের আবেদন অনুমোদন করেছে।
প্রতিদিন এখানে হাজার হাজার শ্রমিক বিশ্বকাপ খেলা দেখতে আসে। তারা প্রায় সকলেই যুবক, বয়স ২০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। তাঁদের বেশিরভাগই ভারত, বাংলাদেশ, কেনিয়া, নেপাল বা পাকিস্তান থেকে আসা। এদের বেশিরভাগই নির্মাণ ক্ষেত্রে যুক্ত এবং টুর্নামেন্টের পরিকাঠামো তৈরির সাথে যুক্ত। প্রত্যেকেরই রয়েছে বন্ধু হারানোর যন্ত্রণা।
Comments :0