একজন সঙ্ঘ প্রচারক থেকে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির হাত ধরে প্রথমে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী তারপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠার কাহিনিকে তথ্য চিত্রাকারে তুলে ধরেছে বিবিসি। নরেন্দ্র মোদীর এহেন রাজনৈতিক উত্থানের পেছনে বিভিন্ন রসদ ও অনুষঙ্গগুলিকে সাজিয়ে তৈরি হয়েছে দুই এপিসোডের তথ্যচিত্র ‘ইন্ডিয়া : দ্য মোদী কোয়েশ্চেন’- এর প্রথম এপিসোডটি প্রকাশ হবার পরই তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। নানা তথ্য ও ভাষ্য সহযোগে বিবিসি’র ছবিতে মোদীর যে চরিত্রায়ন হয়েছে তা একেবারেই পছন্দ হয়নি মোদী সরকারের। তাই বিদেশ মন্ত্রকের তরফ থেকে চাঁছাছোলা ভাষায় ছবিটিকে গালমন্দ করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে এটি পক্ষপাতদুষ্ট, বস্তুনিষ্ঠতাহীন ও ঔপনিবেশিক মানসিকতার।
মোদীকে নিয়ে কোনও ছবিতে যদি আগাগোড়া মোদীস্তুতি না থাকে তাহলে সেই ছবির বিরুদ্ধে তীব্র ও ঝাঁঝালো প্রতিক্রিয়া হবে এমনটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে যখন সামনে এসে যাচ্ছে গুজরাট দাঙ্গার মতো ঘটনা। আগ্রাসী বিরোধিতা তো হবেই। নরেন্দ্র মোদী এবং আরএসএস-বিজেপি’র কাছে সবচেয়ে দুর্বল জায়গা এই ঘটনা। ইতিহাসে নজিরবিহীন এই গণহত্যার ঘটনা গুজরাটে ঘটেছে মোদীর মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময়।
এমন হত্যালীলার সময় মোদীর নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের ভূমিকায় স্তম্ভিত ও বিঘ্নিত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীও নীরব থাকতে পারেননি। মোদীকে রাজধর্ম পালনের উপদেশ দিয়েছিলেন। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এই ঘটনার নিন্দা করা হয়েছিল। আমেরিকার মতো দেশ মোদীর আমেরিকায় পদার্পণ নিষিদ্ধ করেছিল। বিশ্বের দরবারে ভারতের মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল মোদী শাসিত গুজরাটের কারণে। কয়েক হাজার মানুষকে পিটিয়ে, কেটে, পুড়িয়ে মারা শুধু নয়, মহল্লার পর মহল্লা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। অসংখ্য পরিবার-পরিজনহীন হয়ে পড়েছিল। সেইসব সর্বহারা মানুষও তাদের পরিবার আজও ন্যয় বিচারের অপেক্ষায়। যারা প্রকাশ্যে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি তুলে মহাকলোরোলে মানুষ খুন করেছিল তারা সাজা পায়নি।
যে কয়েকজনের সাজা হয়েছিল তারাও এখন সসম্মানে মুক্তি পাচ্ছে। গুজরাট থেকে মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে উত্তরণের পাশাপাশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে প্রবল প্রতাপে মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে সেই ভয়াবহতম দাঙ্গা স্মৃতিকে। তদন্তের গোলাক ধাঁধায় আর আইনের মারপ্যাঁচে সত্য ও বাস্তবের অপমৃত্যু ঘটে যাচ্ছে। একে একে সব অভিযোগ খারিজ হয়ে অভিযুক্তরা ক্লিনচিট পাচ্ছেন। দিল্লিতে সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে তদন্তের গতিপ্রকৃতিও বদলে গেছে।
এতবড় এক গণহত্যার জন্য দায়ী কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার ছিল, পুলিশ ছিল, সেনাবাহিনীও এসে পৌঁছেছিল। কিন্তু দাঙ্গা আটকানোর জন্য কেউ রাস্তায় নামেনি। যারা রাস্তায় ছিল তারাও অজ্ঞাত কারণে নীরব দর্শক ছিল। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে পুলিশই হয়ে ওঠে দাঙ্গার সহায়ক শক্তি। এরপরই বলা হচ্ছে সরকারের কোনও দায় নেই। মুখ্যমন্ত্রী ভূমিকাহীন। সরকারি তদন্তের বাইরে নানা মহল থেকে এযাবৎ যত তথ্য ও ভাষ্য উঠে এসেছে তাতে আঙুল উঠেছে সরকারের সচেতন নিষ্ক্রিয়তার দিকেই। ঘটনা পরম্পরা এই ধারণাই প্রতিষ্ঠিত করে এটা ছিল পরিকল্পিত।
হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনেরই এক চরম অমানবিক পৈশাচিক রূপ। বিবিসি’র ছবিতে হুবহু সরকারি ভাষ্য ও তথ্যের আলোকে মোদীর চরিত্রায়ন হয়নি। তাতে যুক্ত হয়েছে আরও অনেক অপ্রিয় তথ্য ও ভাষ্য। স্বাভাবিকভাবেই মোদী সরকার এই ছবির সর্বাত্মক বিরোধিতা করছে। কিন্তু ইতিহাসের কোনও ঘটনাকে সরকারি তথ্য বা আদালতের রায় দিয়ে আটকে রাখা যায় না। কোনও না কোনোদিন কোনও না কোনোভাবে সত্য উদ্ঘাটন হবেই। মোদীর যদি দায় থেকে থাকে সেটাও দুনিয়ার কাছে প্রকাশ পাবে। বিবিসি’র তথ্যচিত্র হয়তো সময়ের প্রবাহে একটি ধাপ।
Comments :0