Space

মহাকাশ, সেপিয়েন্স হৃদয়ের বর্ণবিচ্ছুরণ

ফিচার পাতা

অক্টোবর ৪, ১৯৫৭। পৃথিবীর ইতিহাসে একটি লাল টুকটুকে দিন। ২৩ ইঞ্চি ব্যাস এবং ৮৩.৬ কিলোগ্রাম ওজনের একটি চার অ্যান্টেনা যুক্ত, beach ball আকারের যন্ত্র পৃথিবীর মাটি ছেড়ে টলমল করে উড়ল এবং পৌঁছালো ৫৭৭ কিলোমিটার উচ্চতায় পৃথিবীর কক্ষপথে। মাত্র বাইশ দিন ছিল তার জীবনকাল। এই বাইশ দিন ধরে সে নিয়মিত রেডিও সংকেত পাঠিয়েছে পৃথিবীতে। মানব সভ্যতার সবথেকে অসম্ভব স্বপ্ন সফল করেছিল মানুষের তৈরি প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক। অর্থ সহযাত্রী।

১৯৫৭ সালের ৫ অক্টোবর সোভিয়েত সংবাদপত্র প্রাভদা একটি আড়ম্বরহীন ছোট কলামে স্পুটনিক-এর উৎক্ষেপণের খবর প্রকাশ করে। সারা পৃথিবীর কাছে কৃত্রিম উপগ্রহ শব্দটি তখনও বেশ তাত্ত্বিক এবং প্রযুক্তিগতভাবে অধরা। কোল্ড ওয়ার এর প্রেক্ষিতে এই সংবাদ আমেরিকার কাছে পার্ল হারবারের থেকেও বড় ধাক্কা ছিল। ১৯৫৮ সালে নাসার প্রতিষ্ঠা, পরবর্তী প্রায় তিরিশ বছরে এই দুই দেশের প্রতিযোগিতামূলক পদক্ষেপ আসলে আমাদের মহাকাশ প্রযুক্তির অনুঘটক। স্পুটনিক মানবসভ্যতায় মহাকাশ যুগের সূচনা করেছিল।

স্পুটনিক-এর পরবর্তী ছয় বছর সোভিয়েত ইউনিয়ন মানুষের মহাকাশ জয়ের সমস্ত রকম স্বপ্নসন্ধানের পথিকৃৎ হয়ে ওঠে। ১৯৬১ সালে ভস্তক ১ এ ইউরি গ্যগারিন এবং ১৯৬৩ সালে ভস্তক ৬ এ ভ্যালেন্তিনা তেরেস্কোভার সাফল্য আমাদের সভ্যতার গতিপথ সম্পূর্ণ বদলে দেয়। যোগাযোগের পাশাপাশি যুদ্ধের অস্ত্র এবং শক্তি সম্পর্কেও নতুনভাবে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়।

মানুষ যে পৃথিবী ছাড়িয়ে অন্তরীক্ষের রহস্য সন্ধানে ছড়িয়ে পড়তে চাইলো, এর শুরু কোথায়, কিভাবে? কেন আমরা এই অদ্ভুত উত্তেজনা অনুভব করি আমাদের এই মহাজাগতিক অবস্থান, একাকীত্ব নিয়ে? সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে মানবদেহের কোষগুলির সাথে নিউট্রন স্টারের গঠনের খুব মিল। আমাদের শরীরের অধিকাংশ এলিমেন্ট বিগ ব্যাং-এর পরবর্তী ৯০০ কোটি বছর ধরে ব্রহ্মাণ্ডের বিবর্তনের ফলে উদ্ভূত হালকা এবং ভারী মৌল সংশ্লেষের সমন্বয়। যেমন হাইড্রোজেন অক্সিজেন, কার্বন, ক্যালসিয়াম, আয়রন। বিগ ব্যাং-এর পরে ব্রহ্মাণ্ডের উষ্ণতা পর্যাপ্ত পরিমাণে কমতে কয়েকশো লক্ষ বছর লেগেছে। তারপর মহাকর্ষের প্রভাবে ধূলিকণা, পদার্থ কেন্দ্রীভূত হয়ে প্রথম নক্ষত্রের জন্ম দিয়েছে। আজ থেকে ৪৬০ কোটি বছর আগে সূর্যের জন্ম এবং ধীরে ধীরে সৌরজগতের সৃষ্টি। পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব প্রায় ৩৭০ কোটি বছর আগে। প্রাইমেট বা আদিম প্রাণীর এর উদ্ভব আজ থেকে প্রায় ৭-৮ কোটি বছর আগে। আদিম মানুষ তৈরি হয়েছে প্রায় ৫৫-৬০ লক্ষ বছর আগে। এই বিবর্তন থেকেই মানুষের মস্তিষ্কের জটিলতার ধারণা পাওয়া যায়। ব্রহ্মাণ্ডে আমাদের অস্তিত্ব সন্ধান আসলে আমাদের সেই উন্নততর চেতনারই মৌলিক চরিত্র।

আজ থেকে প্রায় ৭০ হাজার থেকে এক লক্ষ বছর আগে শুরু হয়েছিল দ্য গ্রেট হিউম্যান মাইগ্রেশন। সময়ের সাথে, প্রকৃতির চরিত্র পরিবর্তনের সাথে তাঁরা জায়গা বদলাতেন। মানুষ তখন শিকারী ছিল। তাঁদের সময়ের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন তাঁরা রেখে গেছেন প্রাকৃতিক গুহার দেওয়ালে, পাথরে। সবথেকে পুরানো গুহাচিত্রটির খোঁজ পাওয়া গেছে স্পেইনে। স্পেনের লা পাসিয়েগা, মালত্রাভিয়েসো এবং আর্দালেস গুহাচিত্রগুলির ইউরেনিয়াম ডেটিং-এ জানা গেছে তারা প্রায় ৬৫ হাজার বছরের পুরানো। এই আবিষ্কার আমাদের আধুনিক মানুষের চেতনার উৎস প্রায় ৫ লক্ষ বছর আগের আদিম পূর্বসূরিদের সময়ের নিয়ে যায়। নিয়েন্ডারথ্যালদের ইউরোপের প্রথম চিত্রকর হিসাবে ভাবা হয়।
প্রাচীন মানুষের গুহাচিত্রগুলি পুঞ্জীভূত সময়। ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে মানুষের আগ্রহের প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায় প্রায় ৪০-৪৫ হাজার বছর আগে, দক্ষিণ জার্মানির অলেনস্টাইন স্টাডেল গুহাচিত্রে। আকাশের তারার চলন দেখে তারা সময়ের ধারণা করতেন। সেইমত পাথরের গায়ে বিন্দু, রেখা অথবা পশুপাখির ছবির মাধ্যমে মহাজাগতিক ঘটনা নথিবদ্ধ করে রাখতেন।

তুষার যুগ শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ২৬ লক্ষ বছর আগে এবং শেষ হয় প্রায় ১৪ হাজার বছর আগে। তারপর ১২,৮০০ বছর আগে হঠাৎই প্রায় ১২০০ বছরের জন্য পৃথিবী আবার এক সংক্ষিপ্ত তুষার যুগে ফিরে যায়। এর ফলে অনেক নতুন, বৃহদাকার প্রজাতি ধ্বংস হয়েছিল। এই সময়কে ইয়াঙ্গার ড্রায়াস বা কোল্ড স্ন্যাপ বলে। এর কারণ এখনও গবেষকের কাছে রহস্য। অনেকেই বিতর্কিতভাবে মনে করেন একটি ধূমকেতুর ধাক্কায় পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চলের আকাশে কার্বনজাত পদার্থ তৈরি হয় যার ফলে সূর্যের আলো আসা বন্ধ হয়ে যায় এবং উষ্ণতা অনেক কমে যায়। দক্ষিণ ফ্রান্সের লাসকু গুহায়, আজ থেকে প্রায় ১৭ হাজার বছর আগের গুহাচিত্রে, দক্ষিণ তুরক্সের গোবেক্লি তেপে মন্দিরের গায়ে, প্রায় ১২ হাজার বছর আগের আঁকায় এই ধুমকেতুর আঘাতের বর্ণনা পাওয়া যায়। আদিম মানুষ বুঝেছিল, সময় একমুখী, এবং ভবিষ্যতের জন্য অতীতের এই সন্ধান রেখে যাওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

জ্যোতির্বিজ্ঞানী আন্তন পানেকোক তাঁর Socialism and Religion প্রবন্ধে লিখছেন,

"primitive people believed the nature around them to be filled with all sorts of mysterious spirits. In their economy they depend wholly upon nature. Many natural forces and unknown powers threaten their lives and their work, while others are favorable, useful, benefiting to them. They have no means of knowing and controlling those powers. These appear to them as supernatural, manlike, forces with independent wills, and they seek to influence them with the means of their limited mental horizon, with prayers, sacrifices, or, perhaps, threats."

আমাদের চেতনার মধ্যেই এই দ্বন্দ্বের সন্ধান পাওয়া যায়। একদিকে মানুষ ব্রহ্মাণ্ডের রহস্যকে ভয় পেয়েছে, কুসংস্কারের জন্ম হয়েছে, অন্যদিকে সেই মানুষই আগুনের, চাকার, পাথরের অস্ত্রের আবিষ্কার করেছে। আকাশের তারাদের সাহায্যে পথ চিনেছে, সময় মেপেছে, ফসল ফলিয়েছে।

আমাদের কগ্নিটিভ ডেভেলপমেন্ট বা চেতনাপ্রবাহের সাথে ব্রহ্মাণ্ডের সম্পর্ক বেশ মজার। অনেক সময় এমন হয়, আমরা মেঘের মধ্যে একটা খরগোশ বা একটা ভাল্লুক দেখতে পাই! চাঁদের চোখ নাক মুখ তো আমরা প্রায় সবাই দেখি। অথবা কখনও মনে হয় দেওয়ালে জলের দাগটা ঠিক একটা টুপিওয়ালা বুড়োর মতো! আমরা সবাই এমন অনেক সময়ই  দেখি। একে বলে pareidolia (প্যারিডোলিয়া)। কোনও অনিয়মিত আকারের মধ্যে আমরা অর্থপূর্ণ কিছু দেখতে পাওয়া,  এলোমেলো, ছড়িয়ে থাকা বস্তুর মধ্যে একটা সংযোগ খুঁজে পাওয়া, যা নেই তাকে খুঁজে পাওয়ার এই প্রবণতাকে Apophenia (অ্যাপোফিনিয়া) বলে। জার্মান মনোবিদ ক্লাউস কনরাড ১৯৫৮ সালে স্কিৎজোফ্রেনিয়ার প্রাথমিক লক্ষণ বিষয়ে তাঁর একটি গবেষণায় প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। Human tendency to seek pattern in random information. প্যারিডোলিয়া এই অ্যাপোফিনিয়ারই একটি বিশেষ দিক। মনস্তত্বের খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই Apophenia (অ্যাপোফিনিয়া)। শব্দটির সাথে হয়তো আমরা সবাই পরিচিত নই, তবে আকাশ দেখার ক্ষেত্রে এর এক মজার ভূমিকা আছে। ঠিক এভাবেই প্রাচীন মানুষ আকাশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তারাদের কাল্পনিক রেখা দিয়ে যোগ করে অনেক আকৃতি বা অবয়ব তৈরি করেছিল এবং সেই অনুযায়ী তাদের নাম দিয়েছিল। এদের বলা হয় constellation বা নক্ষত্রপুঞ্জ। যেমন ১২টি রাশিচক্রের কথা আমরা জানি। এদের অবস্থান লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এরা পৃথিবীকে এক বৃত্তাকার পথে ঘিরে থাকে। তাই প্রাচীন ব্যাবিলনে এই ১২ টি রাশিচক্র ছিল ক্যালেন্ডারের ১২টি মাস। কারণ আকাশে এদের উদয় এবং অস্তের মধ্যে সময়কাল ঠিক তিরিশ দিন। মাসের ধারণা এভাবেই পেতেন তারা।

আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের অবয়ব তৈরি করেছেন মূলত প্রাচীন দার্শনিকরা। প্লেটো, গ্যালিলিও, ইউক্লিড, কোপারনিকাস, থেকে কেপলার হয়ে নিউটন, বোর, উইলিয়াম হার্শেল এর আবিষ্কার আমাদের বহির্বিশ্ব এবং অন্তর্জগতের সেতুবন্ধ করেছে। গণিত থেকে শিল্পে, মানবসভ্যতার আদি থেকে আজ অবধি, ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য, তার সত্যসন্ধান বার বার উপলব্ধ হয়েছে। তবু ব্রহ্মাণ্ডকে দেখার ক্ষেত্রে, উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে আমাদের কিছু শারীরবৃত্তীয় সীমাবদ্ধতা আছে। ব্রহ্মাণ্ডের খুব ক্ষুদ্র অংশ মানুষের তৈরি যন্ত্রের চোখে ধরা পড়ে। তার মধ্যে আমাদের চোখ দেখে শুধুমাত্র দৃশ্যমান তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো। তার বাইরের ব্রহ্মাণ্ডের কাছে আমাদের চোখ পৌঁছায় না। আরও একটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো, মাত্রা বা ডাইমেনশন। আমরা ত্রিমাত্রিকের বেশি দেখতে পাই না। সেভাবে আমাদের মগজ কল্পনাও করতে পারে না। ফলে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের সাথে বা ডি সিটার স্পেসের তত্ত্বের সাথে যোগাযোগ বেশ কঠিন বিষয়ই ছিল আমাদের কাছে। সময়ের ধারণা আমাদের কাছে গাণিতিক। তাকে আমরা স্থানিক ভিত্তিতে কিভাবে দেখব? ত্রিমাত্রিক তলের উপর মহাকর্ষের প্রভাব কি করে ভিসুয়ালাইজ করব? সময়ের সাথে প্রযুক্তি এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করে চলেছে।

স্পুটনিক আধুনিক মহাকাশ প্রযুক্তির যে পথ তৈরি করেছিল, তাকে অনুসরণ করেছে নাসার ভয়েজার। ১৯৭৭ সালে মানুষের প্রথম ইন্টারস্টেলার মিশন ভয়েজার ১ সৌরজগতের সীমানা অতিক্রম করেছে। তারপর একে একে এসেছে স্পিৎজার, হাবল, ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন থেকে আজকের জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। মানুষের আবিষ্কার প্রত্যেকবার মহাকাশের নতুন সীমানা অতিক্রম করেছে।

১৯৯০-এর ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ ভয়েজার ১ যখন প্রথিবী থেকে ৬০০ কোটি কিলোমিটার দূরে এবং আক্ষরিক অর্থেই মহাকাশে নিজের গতি বাড়িয়ে আরও দূরে চলে যাচ্ছে, বিজ্ঞানীরা জানতেন ভয়েজার আর পৃথিবীতে ফিরবে না কোনোদিন। সেই সময় কার্ল সাগানের অনুরোধে মিশন কম্যান্ড ভয়েজারের রাডারের মুখ পৃথিবীর দিকে ঘুরিয়ে দেয়। শেষবারের মতো নিজের বাড়ি পৃথিবীর দিকে ফিরে তাকানোর পরে ভয়েজার তার ইমেজিং সিস্টেমের সাহায্যে ৬০ টি ছবির একটি সিরিজ তোলে, সৌরপরিবারকে মনে রাখার জন্য। সেই সিরিজে মহাকাশ থেকে পৃথিবীর একটি ছবি উঠেছিল। সূর্যের বিক্ষিপ্ত রশ্মির মধ্যে পৃথিবীরকে এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নীলচে বিন্দুর মতো লাগছিল। মহাকাশবিজ্ঞানের ইতিহাসে সেটিই মহাকাশ থেকে তোলা পৃথিবী এবং সৌরপরিবারের একমাত্র ছবি। কার্ল নাম দিলেন Pale Blue Dot. তিনি লেখেন, "Look again at that dot. That's here. That's home. That's us."

সেই 'শূন্যের উপর পোস্তা' করা ঘরে প্রাণের সন্ধান মিলেছে। আশ্চর্য 'চেতনার রঙে' চুনি পান্না রাঙা হয়েছে। মহাবিশ্বে, এই তুচ্ছতম অস্তিত্বের মধ্যেই আমরা চেতনার অন্তর্নিহিত ব্রহ্মাণ্ডের সন্ধান করছি।
 

Comments :0

Login to leave a comment