Post Editorial

সাঁওতাল বিদ্রোহ গণসংগ্রামের অবিস্মরণীয় অধ্যায়

উত্তর সম্পাদকীয়​

ডাঃ পুলিন বিহারী বাস্কে

বাংলা তথা ভারতের গণসগ্রামের ইতিহাসে সাঁওতাল বিদ্রোহ এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুবে বাংলার দেওয়ানি পেল। এ কর্তৃত্ব পাবার পর থেকে ইংরেজ ব্যবসায়ীরা রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে কৃষকদের ওপর রাজস্বের বোঝা ক্রমাগত বাড়াতে লাগল। লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের (১৭৯৩) প্রবর্তন করলেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি গ্রহণের পর থেকে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে কৃষকদের মধ্যে একে একে বিদ্রোহ মাথা চাড়া দেয়। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ, চূয়াড় বিদ্রোহ, পাইক বিদ্রোহ, তিতুমীরের নেতৃত্বে ফরাজি বিদ্রোহ, দুদু মিয়ার নেতৃত্বে সংগঠিত ওয়াহাবি আন্দোলন ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও সুবে বাংলার বিভিন্ন স্থানে জনজাতীয় কৃষকদের অনেক বিদ্রোহ ওই সময়কালে সংগঠিত হয়েছে।
ওই সব সংগ্রাম বাংলা তথা ভারতের গণসগ্রামের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। বাংলা তথা ভারতের কৃষক সংগ্রামের ইতিহাসের অন্যতম গৌরবময় ঘটনা হলো ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ। 
সাঁওতাল পরগনা গঠন
১৮৫৭ সালের ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম সিপাহী বিদ্রোহের দুই বছর আগেই পূর্ব ভারতে চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছিল। যার পরিণামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বেশ কিছু প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হয়। সাঁওতাল পরগনা নামে নতুন এক জেলা গঠিত হয়। ইংরেজ শাসনের ইতিহাসে সর্বপ্রথম একটি জাতি গোষ্ঠীর নামাঙ্কিত জেলা তৈরি হয়েছিল সাঁওতাল পরগনা (১৮৫৫)।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এর আগে পর্যন্ত বীরভূম জেলার সীমানা দেওঘর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আসলে, রাজনগরের রাজার যে প্রাক্তন জমিদারি এলাকা তার বৃহদাংশ নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বীরভূম জেলার প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করেছিল। ভূমি আইনের সংশোধন করে, ওই নবগঠিত জেলার ৫২টি মৌজায় জমির অবাধ বেচাকেনা নিষিদ্ধ হলো। সাঁওতাল বিদ্রোহের মূল কেন্দ্র ছিল, দামিন-ই–কো। এই ফার্সি কথাট্টা র অর্থ পাহাড়ের ওড়না।
বাংলা প্রেসিডেন্সির পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত ওই এলাকা মধ্য যুগে বাংলার প্রবেশ পথ ছিল। পাহাড় ও অরণ্য ঘেরা রাজমহল সন্নিহিত এলাকা দিয়েই মধ্যযুগে আক্রমণকারীরা বাংলায় প্রবেশ করেছে। ওই এলাকার বসবাসকারীরা মূলত আরণ্যক জনগোষ্ঠী। ওই জনজাতির মানুষেরা, মূলত শিকারিজীবী, কৃষি কার্যে অভ্যস্ত হয়নি।
ইংরেজরা ওই জনজাতির মানুষদের কৃষিকার্যে আগ্রহী করার চেষ্টা করেও কোনও ফল পায়নি। তবে এই সমতল ভূমিকে ইংরেজ শাসকরা আবাদ যোগ্য করার জন্য উদ্যোগী হয়। এতে রাজস্বও বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে কৃষিজীবী সমাজ গড়ে উঠলে এলাকার শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রেও তা সহায়ক হবে।
১৮৩২-৩৩ সালে তৎকালীন বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ও ভাগলপুর জেলার কিছু অংশ নিয়ে ওই নতুন এলাকা গঠন করার পরে ইংরেজ শাসকদের উদ্যোগে সবচেয়ে বেশি সাড়া মিলল সাঁওতাল জনজাতি মানুষের কাছ থেকে। ছোট নাগপুরের মালভূমি এলাকা, বীরভূম জেলার বিভিন্ন এলাকা, ভাগলপুর পালামৌ প্রভৃতি স্থান থেকে সাঁওতাল জনজাতির মানুষেরা নতুন জমির খোঁজ পেয়ে দলে দলে ওই এলাকায় আসতে লাগল। 
আগন্তুক ওই সব মানুষের সবল বাহুর আঘাতে কুমারী মাটির ঘুম ভাঙল। জঙ্গল সাফ করে, পাথর সরিয়ে-বাঘ-ভল্লুকের সঙ্গে লড়াই করে, এরা খুব দ্রুত গতিতে এলাকাটি শস্যশ্যামল করে তুলল। সাঁওতাল কৃষকদের ওই এলাকায় আসার পিছনে ছিল ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর প্রবর্তন। যার ফলে বাংলা বিহার-ওডিশার কৃষকরা তাদের পুরুষানুক্রমিক জমির মালিকানা হারালো। ওই ব্যবস্থায় জমির মালিক হয় নতুন জমিদাররা, আর কৃষকরা তাদের প্রজায় পরিণত হলো। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আঘাতে বিপুল সংখ্যক কৃষক জমির অধিকার হারিয়ে ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হলো। নতুন জমিদার তাদের জমি কেড়ে নিল। ওই সব জমি নতুনভাবে পত্তন দেবার কাজ শুরু হলো। উদ্দেশ্য রাজস্ব বৃদ্ধি। এই এলাকার পরিমাণ ছিল ১৩৬৬.০১ বর্গ মাইল। তার মধ্যে ৫০০ বর্গ মাইল সমভূমি, বাকি সম্পূর্ণ পাহাড়। আবার এর মধ্যে ২৪৬ বর্গ মাইল ছিল সম্পূর্ণ অরণ্য ভূমি। ১৮৫০ সালের তথ্যে দেখা যায় যে, তখন পর্যন্ত ২৫৪ বর্গ মাইল জমি আবাদ করা গিয়েছে। নবাগত সাঁওতাল জনজাতির মানুষরাই ওই আবাদের কাজ করল।
১৮১০-১১ সালে বুকানল হ্যামিল্টন ভাগলপুর জেলার জরিপের করে দেখেন, দুমকা ও তার পার্শ্বস্থ এলাকায় ওডিশার ধলভূম, বরাভূম ছোটনাগপুর, পালামৌ, হাজারিবাগ, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও বীরভূমের কোনও কোনও এলাকা থেকে বেশ কিছু সংখ্যক সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষজন এসে বসবাস শুরু করেছেন। ১৮৩৬ সালে ডানবারের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে ওই সময়কালে দামিন এলাকায় ৪২৭টি জমি পত্তন হয়েছিল।
১৮৫১ সালে ক্যাপ্টেন শের উইল মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম জেলার অন্তর্গত এলাকাগুলি এবং রাজমহল পাহাড় এলাকায় প্রথম জরিপের কাজ করেছিলেন। তাঁর প্রতিবেদন অনুয়ায়ী তখন ওই এলাকার জনসংখ্যা ছিল ৮২,৭৯৫ জন। গ্রাম সংখ্যা ১৪৭৮টি। ১৮৩৮ সালে এখান থেকে কোম্পানির রাজস্বের পরিমাণ ছিল দুই হাজার টাকা, ১৮৫১ সালে যা বেড়ে হয়েছিল ৪৩,৯১৯ টাকা।
শোষণের সুত্রপাত
পার্শ্ববর্তী বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ও ভাগলপুর জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এল। এই ব্যাপারিরা ব্যবসার নামে ডাকাতি ও লুণ্ঠন শুরু করল। তারা নিরক্ষর ও সাদাসিধে প্রকৃতির সাঁওতালদের ফসল কেনার নামে বঞ্চনা ও প্রতারণা শুরু করল। ব্যাপারিরা কেনার সময়ে একরকম বাটখারা যার নাম ছিল ‘কেনারাম’ বা ‘বড় বউ’ আর জিনিস বিক্রির সময়ে আর একরকম বাটখারা ব্যবহার করত যার নাম ছিল ‘বেচারাম’ বা ‘ছোট বউ’। সাঁওতালরা কুড়ির বেশি সংখ্যা জানত না। এরও সুযোগ নিত ব্যাপারিরা। বিক্রেতা সাঁওতাল যতই ফসল জোগাতো, ব্যাপারিরা তা ওজন করে উনিশ পর্যন্ত বলে আবার রাম অর্থাৎ এক-এ ফিরে যেত। সে জন্য ফসল জোগাতে জোগাতে ক্লান্ত হয়ে এক সাঁওতাল বলে উঠেছিল— ‘এক বার তো বিশ বোল বাবু’।
এইসব প্রতারণার জন্যই বহিরাগত ব্যাপারিদের বলা হতো 'দিকু'। দিকু মানে প্রতারণা, উৎপীড়ন। এরাই ছিল আবার মহাজন। সর্বস্বান্ত সাঁওতালদের চড়া হারে সুদে টাকা ধার দিত। ফসল উঠতে না উঠতেই সাঁওতালদের সব ফসল তুলে দিতে হতো ওই মহাজনদের কাছে। এর সাথে ছিল জমিদারি শোষণ।
জমিদার ও মহাজনদের নির্মম শোষণ দামিনের বাইরের সাঁওতালদেরও একইভাবে নিঃস্ব করছিল। এর সঙ্গে ছিল নীলকরদের শোষণ। ছিল রেলপথ বসাতে আসা দেশি বিদেশি ঠিকাদার ও অফিসারদের শোষণ ও নিপীড়ন। সেখানে খাটতে যাওয়া সাঁওতাল নারীরা লাঞ্ছনারও শিকার হতে লাগল।
এসব মিলিয়ে সাঁওতাল জনজাতির মানুষদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন দারুণভাবে বিপর্যস্ত হলো। তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হলো। প্রকৃতির পূজারী মারাং বুরু পাহাড় কেটে রেল লাইন পাতার জন্য তাদের মনে আশঙ্কা ও ভীতি জেগে উঠল। এই সমস্ত ঘটনায় অশান্তির আগুন জ্বালালো।
শুরু বিদ্রোহ
প্রথম দিকে বিক্ষুব্ধ একটা অংশ মহাজনদের ঘরে ডাকাতি করে শোষণ ও বঞ্চনার প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। এতে আতঙ্কিত মহাজন ও জমিদাররা দারোগা মহেশ লাল দত্তের শরণাপন্ন হলো। বীরসিং সহ আরও অনেককে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে জেলে পুড়ল পুলিশ। ওই সব মিথ্যা মামলায় অনেক নিরীহ ব্যক্তিকে জড়িয়ে দেওয়ায় ক্ষোভ আরও বাড়ল। এরই মাঝে খবর ছড়ালো, রেললাইন পাতার কাজে নিযুক্ত দু’জন সাঁওতাল রমণীর উপর পাশবিক অত্যাচার করা হয়েছে।
দিকে দিকে বিপর্যস্ত সাঁওতালদের কাছে নতুন এক বার্তা এল ভগনাডিহি গ্রামের চার ভাই— সিধো, কানহু, চাঁদ ও ভৈরোর কাছ থেকে। ওদের বাবা চুনা মুর্মু একসময়ে ষাট বিঘা জমির মালিক ছিলেন। মহাজনদের কবলে পড়ে তিনিও সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন।
ভগনাডিহি গ্রামে এক ‘গালমারাও’ সভা আহ্বান করলেন ওই চার ভাই। সাঁওতালদের নিয়ম অনুযায়ী শালের ডাল ঘোরানো হলো চিরদিকে। ওটাই সভা ডাকার নিয়ম। ৩০ জুন ১৮৫৫ সালে দলদলি পাহাড়ের কাছে ভগনাডিহি গ্রামে দূরদূরান্ত থেকে দলে দলে সাঁওতাল এসে হাজির হলো। ওই জমায়েতে ঠিক হলো, দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে তারা ইংরেজদের কাছে প্রতিকারের জন্য যাবে। এক দল যাবে সিউড়িতে। সেখানে জেলার কালেক্টর সাহেব আছেন। সিউড়ি থেকে ওরা যাবে কলকাতায়, যেখানে থাকেন লাটসাহেব। তাঁকেও সব জানিয়ে প্রতিকার চাইবে। ভগনাডিহি গ্রামে জমায়েতের পর হাজার দশেক মানুষ ওই লক্ষ্য নিয়ে করল গণঅভিযান। 
আতঙ্কিত জমিদার ও মহাজনরা দলে দলে শরণার্থী হলো মহেশলাল দারোগার। দারোগা অভিযাত্রীদের বাধা দিলেন। তিনি সিধো, কানহুকে গ্রেপ্তার করলেন। এতেই আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল। সেদিন ছিল ৭ জুলাই। গ্রেপ্তারের ঘটনায় ক্ষিপ্ত অভিযাত্রীরা চড়াও হলো দারোগা ও তার সঙ্গী সিপাই বাহিনীর উপর। অভিযাত্রীদের হাতে প্রাণ গেল তাদের। পাঁচ কাঠিয়া গ্রামের রাক্ষসী মায়ের থানে তাদের সহ ওই গ্রামের পাঁচজন মহাজনকেও বলি দেওয়া হলো। ক্ষোভের আগুন এবার দাবানল হয়ে জ্বলে উঠল। এরই মধ্যে সাঁওতাল জনজাতির বাইরের অনেক মানুষ ওই অভিযানে যোগ দিল - কামার, দোলা, কুমোররা। এক কথায়, মহাজন ও জমিদারদের শোষণে জর্জরিত সমস্ত গরিব মানুষের বিশাল বাহিনী এগিয়ে চলল।
একটি বাহিনী বর্তমান বীরভূম মুরারই নলহাটি হয়ে যাত্রা করল রামপুরহাট অভিমুখে। পথে পলশায় রেল তৈরির কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের শিবির দখল করল তারা। এই এলাকা অতিক্রম করে তারা চলল রেলওয়ের প্রধান কেন্দ্র রামপুরহাটের দিকে। সেখানে বিদ্রোহীদের গতিবিধি লক্ষ করার জন্য একটি টাওয়ার তৈরি করেছিল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। 
রামপুরহাটের পশ্চিম দিকে ব্রাক্ষ্মণী নদীর তীরে নারায়ণপুরের ব্যবসা কেন্দ্র সহ সমস্ত এলাকাই তখন বিদ্রোহীদের দখলে। সিউড়ি অভিমুখে এক বিরাট বাহিনী ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে এসে পৌঁছালো। বর্ষাকাল ময়ূরাক্ষী নদী তখন কানায় কানায় পূর্ণ। নদীর অপর তীরে ছিল লাঙ্গুলিয়া থানা। সেখানে এনসাইন মরিসের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনীর কামান ও বন্দুকের গুলিতে আদিম অস্ত্রে সজ্জিত সাঁওতাল বাহিনী পর্যুদস্ত হলো। সাঁতরে নদী পার হতে গিয়ে অনেকে নিহত হলো। ২০ জুলাই ওই ঘটনা ঘটল। মোট ৬১টি মৃতদেহ সেখানে পাওয়া গেল। তবে মৃতের সংখ্যা আরও বেশি ছিল। জলের স্রোতে অনেক মৃতদেহ ভেসে গিয়েছিল।
বিদ্রোহীদের একটি বাহিনী রাজনগর থানায় হানা দেয়। রাজনগরের তৎকালীন রাজা সপরিবারে নগর ছেড়ে চলে যান। এখানে বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করতে গিয়ে ইংরেজ বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ টু লামিন নিহত হন। তাঁর সহকারী ১৩ জন সিপাহীও বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়েছিল। তবে নিহত বিদ্রোহীদের সংখ্যা ছিল তিন শতাধিক। এ দিকে সিউড়ি শহরে তখন চরম আতঙ্ক। বিদ্রোহীদের ধরবার জন্য রাজনগরের দিকে পাঠানো শহর রক্ষার জন্য মাত্র ৫০ জন সিপাহী পাঠালাও শহরবাসীরা আতঙ্কে শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিল। ট্রেজারির টাকা পয়সা একটি বড় ইঁদারার মধ্যে লুকিয়ে রাখা ছিল। অনেক পরিবারের ধনসম্পদ ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল বাড়ির ইঁদারায়। 
বিদ্রোহ দমনে চরম নৃশংসতা
ইংরেজ সরকার জুলাই মাসের প্রথম থেকেই বিদ্রোহীদের দমনের জন্য সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করে। পাকুড় ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলিতে কামান বন্দুকে সুসজ্জিত সেনাবাহিনী রামপুরহাট, সিউড়ি-রাজনগর সর্বত্রই আদিম অস্ত্রে সজ্জিত বিদ্রোহী বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই অবস্থাতেও কয়েক মাস যাবৎ বিদ্রোহীরা মরণপণ লড়াই করে। কিন্তু তাদের পক্ষে শেষরক্ষা করা সম্ভব ছিল না। এ জাতীয় সুশিক্ষিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে যে লড়তে হবে এটা কখনো ভাবেনি তারা বা সে চেতনাও ছিল না। ইংরেজ সরকার এই বিদ্রোহ দমনের জন্য লাখ খানেক সেনা নিয়োগ করেছিল। বিদ্রোহীদের সংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি ছিল ইংরেজ বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা। সুদক্ষ সেনাপতিরা ওই সব বাহিনীর পরিচালনা করেছিলেন। ইংরেজ বাহিনী বিদ্রোহীদের নির্বিচারে হত্যা করে। ভগনাডিহি থেকে আরম্ভ করে, গোটা এলাকার সাঁওতাল গ্রামগুলি তারা পুড়িয়ে ছারখার করে। কোনোরকম বিচার ছাড়াই শত শত বিদ্রোহীকে সে দিন ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। সিউড়ি, রাজনগর, দুমকা প্রভৃতি স্থানে গাছে ঝুলিয়ে অনেককে ফাঁসি দেওয়া হয়। বিদ্রোহীদের শীর্ষ নেতা দুই ভাই— সিধো ও কানহুকেও একই পদ্ধতিতে প্রকাশ্যে গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।
শত শত বিদ্রোহীকে জেলে ঢোকানো হলো। অনেককে পাঠানো হলো সুদূর ব্রহ্মদেশের (বর্তমান মায়ানমার) কারাগারে। সৈন্যবাহিনীর বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার মধ্যেও বিদ্রোহী সাঁওতালরা নিজেদের গ্রাম, ঘরবাড়ি তথা সামগ্রিকভাবে অস্তিত্ব রক্ষা করতে আপ্রাণ লড়াই করেছে। সেক্ষেত্রে তাদের দৃঢ়তা ও মনোবল ছিল অদম্য।
সংগ্রামের চরিত্র
১৮৫৫ সালের ১০ নভেম্বর ব্রিটিশ সরকার সামরিক আইন জারি করল। ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বিদ্রোহের আগুন জ্বলেছিল। অবশ্য তারপরেও কয়েক মাস এখানে ওখানে আগুন জ্বলেছিল। ব্রিটিশ সহায়ক ছিল জমিদাররা। জাতি ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে গরিব মানুষেরা বিদ্রোহী সাঁওতালদের পাশে গিয়ে এই বিদ্রোহের শরিক হয়েছিল। যার ফলে, এই বিদ্রোহ সাঁওতাল জনজাতির সীমানায় আবদ্ধ না থেকে এক গণবিদ্রোহ ও গণসংগ্রামে পরিণত হয়েছিল।
শ্রেণি চরিত্রে এই বিদ্রোহ ছিল কৃষকের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অংশ। চারিত্রিক বিচারে, এই গণসংগ্রাম ছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসক এবং তাদের সহযোগী সমস্ত শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তাই, দেখা যায়, এ গণবিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশ শাসকরা আর তাদের সহায়ক হিসাবে বিদ্রোহ দমনের মুর্শিদাবাদের নবাব, পাকুড়ের রাজপরিবারের, মহেশ দারোগার জমিদার পরিবার, বীরভূমের হেতমপুরের জমিদার প্রমুখ। ওই সব জমিদারদের কেউ হাতি কেউ সিপাহী দিয়ে সহায়তা করেছিল। তাছাড়া সৈন্যবাহিনীর জন্য রসদ জোগানো তো ছিলই। 
এ বিদ্রোহের সংবাদ সাগর পাড়েও পৌঁছেছিল। তার নিদর্শন কার্ল মার্কসের ‘নোটস্ অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’। তিনি লিখেছেন-- ১৮৫৫-৫৬ সাল, সাঁওতালদের বিদ্রোহ। পশ্চিমবঙ্গের রাজমহল পাহাড়ের এক দল আদিবাসীকে সাত মাসের গেরিলা যুদ্ধের পর ১৮৫৬-এর জানুয়ারিতে দমন করা হলো। দমন করা হলেও সেই অভ্যুত্থান থেকে গেল ভারতীয় সমাজের ইতিহাসে এক মাইল ফলক হিসাবে। তার রেশ চলতেই থাকবে।
আজও লুট চলছে
বর্তমান সময়ে সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। জল, জঙ্গল ও জমির মৌলিক অধিকার তীব্র আক্রমণের সম্মুখীন। সরকারের নীতির কারণে বিপুল সংখ্যক আদিবাসীকে নিজেদের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ হতে হচ্ছে। বীরভূমের দেওচা পাঁচামী থেকে পুরুলিয়ার তিলাবনী পাহাড় তার জলন্ত উদাহরণ। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের বেশির ভাগই আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় অবস্থিত। কেন্দ্রীয় সরকার আদিবাসীদের বঞ্চিত করে কপোরেটদের স্বার্থে অবস্থান নিয়েছে। সংবিধানে এই আদিবাসীদের স্বার্থে বিভিন্ন আইন ও বিধি সংশোধন করে আদিবাসীদের জন্য নির্ধারিত অপর্যাপ্ত সুরক্ষার উপরেও আঘাত নামিয়ে আনছে সরকার।
নয়া উদারনীতির প্রভাব আদিবাসী সমাজে প্রকট আকার ধারণ করেছে। পরিচিত সত্তাকে নিয়ে ঘৃণ্য রাজনীতি চলছে। ভাষা, ধর্ম, সম্প্রদায়, সংস্কৃতি পরম্পরা সমস্ত কিছুতেই বিভাজনের রাজনীতির শিকার আদিবাসী সমাজ। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আদিবাসী মানুষের রক্তে রয়েছে। তাই, সাঁওতাল বিদ্রোহ প্রেরণা দেয়, রাজ্যে তৃণমূল সরকার ও কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে সব ধরনের লড়াই আরও তীব্র, সর্বব্যাপী, বৃহত্তর ও শক্তিশালী করার।

 

Comments :0

Login to leave a comment