বইকথা — নতুনপাতা, বর্ষ ৩
আদিবাসী জাগরণের কথা
প্রদোষকুমার বাগচী
ভারতবর্ষের বুকে ইংরেজ রাজত্বের ২০০ বছরের ইতিহাসে কৃষক সম্প্রদায়ের মানুষ বারংবার বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। ইংরেজ বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড হিসেবে আদিবাসী ও কৃষক সমাজ কোনদিনই মেনে নেয়নি। তারাই প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরেছিল। কেননা আদিবাসী কৃষকরা মনে করতেন সারা বছর তারা যে জমির পরিচর্যা করে ভালোবেসে চাষাবাদ করে থাকেন সেই জমির ফসলে একান্ত তাদেরই অধিকার। তাই যখনই ব্রিটিশ সরকার ও তাদের ধামাধরা জমিদার জোতদার ও মহাজনের দল সেই অধিকারে থাবা বসায় শোষণের যন্ত্রে পিষ্ট করে অতিষ্ঠ করে তোলে কৃষকদের জীবন, কৃষক সমাজ সহজে তা মেনে নেয়নি। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কৃষি ও ভূমি সংক্রান্ত শোষণের মূল ভিত্তি ছিল ভূমি বন্দোবস্ত সংক্রান্ত আইনগুলো। চিরস্থায়ি বন্দোবস্তের আগে ও পরে ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে অসংখ্য আদিবাসী মানবগোষ্ঠী যারা কৃষিকেই মূলত পেশায় রূপে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন বা করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন— বিদ্রোহ করেন। ‘আদিবাসী জাগরণ’ শীর্ষক বইটিতে ইতিহাসের স্বাধীন গবেষক সজল কান্তি দাশগুপ্ত বিস্তারিতভাবে অষ্টাদশ থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সেই বিদ্রোহগুলিকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। লেখক ‘চাকমা উপজাতি বিদ্রোহ (১৭৭৬-৮৭) থেকে শুরু করে ‘পাহাড়িয়া বিদ্রোহ (১৭৮৯- ৯১) ‘দ্বিতীয় চুয়াড় বিদ্রোহ’( ১৭৯৮-৯৯), বগড়ীর নায়ক বিদ্রোহ (১৮০৬-১৬) ‘গারো উপজাতির সশস্ত্র সংগ্রাম’ (বিভিন্ন পর্যায়ে) ‘সুসঙ্গের হাতি খেদা বিদ্রোহ’ ‘ময়মনসিংহের পাগলপন্থী বিদ্রোহ’, ‘তিপ্রা বিদ্রোহ’ (১৮৫০) ‘কুকি বিদ্রোহ (১৮৪৪-৯০), ‘তিলকা মাঝির প্রথম সাঁওতাল বিদ্রোহ’ (১৭৮৪),হুল (১৮৫৫-৫৬) উনবিংশ শতাব্দীর ‘মুন্ডা-কোল-ভিল-খাসি উপজাতি বিদ্রোহ’, ‘ভুমিজ বিদ্রোহ’ (১৮৩২), ‘গোন্ডা বিদ্রোহ’( ১৮৩৭-৫৬), ‘নাগা বিদ্রোহ’ ( ১৯৪৭) প্রভৃতি জনজাতির অভ্যুত্থান বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এছাড়া বঙ্গপ্রদেশের বাইরে পাঞ্জাবের কুকা বিদ্রোহ, মহারাষ্ট্রের ওয়ার্লি বিদ্রোহ নিয়েও লেখক মূল্যবান পর্যালোচনা করেছেন। কয়েক দশক ধরে ভারতীয় উপমহাদেশের এই আদিবাসী কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করছি। দেখেছি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের ইতিহাসের পড়ুয়াদের এই বিষয়গুলি একটু জটিল মনে হয়। জনজাতি উপজাতি বিদ্রোহ গুলির কিছু বিশেষ চরিত্র উপাদান ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ধর্মেরও নির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এসব তথ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে বিখ্যাত গবেষণা রয়েছে ঐতিহাসিক অধ্যাপক বিনয়ভূষণ চৌধুরী, অধ্যাপক শুচিব্রত সেন প্রমুখের। সজল কান্তি দাশগুপ্তের কাজটি এরই পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রিয়তা লাভের উপযুক্ত।
সজলকান্তি দাশগুপ্ত।
আদিবাসী জাগরণ। রেণু প্রকাশনী।১/ডি, চ্যাটার্জী লেন, কলকাতা-১২। প্রথম প্রকাশ-২০১৭। মূল্য- ৪৯৯টাকা
Comments :0