সৌরভ চক্রবর্তী
খুবই কষ্টকর এবং উদ্বেগজনক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি। দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে, সেই সাথে বেড়েই চলেছে রাতের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এবং রাতের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার মধ্যে ব্যবধান কমছে। এটা ভয়ানক উদ্বেগের বিষয়। নিদাঘ তপ্ত দুপুরের তাপক্লেশ থেকে রাতে আরাম পাওয়ার কথা, কিন্তু রাতের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং রাতের দীর্ঘায়ত বর্ধিত তাপমাত্রার জন্য ব্যাঘাত ঘটছে রাতের ঘুমের, ক্ষতি হচ্ছে স্বাস্থ্যের, মৃত্যু হচ্ছে 'হিট স্ট্রোকে', তীব্র ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে অ-সুরক্ষিত বহিরঙ্গন শ্রমিক - খেতমজুর, কৃষক, নির্মাণ শ্রমিক, ভ্যান - রিকশাচালক, হকার, বাজারের বিক্রেতা, বস্তিবাসী মানুষ, গরিব প্রান্তিক মানুষ, 'গিগ' শ্রমিক, শিশু, বৃদ্ধ এবং মহিলাদের ওপর। এরাই জলবায়ু পরিবর্তনে অ-সুরক্ষিত গ্রুপ, এরাই মূল ক্ষতিগ্রস্ত।
ভিলেনের নাম আর্দ্রতা
যদিও তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টাকেই আমরা তাপক্লেশের কারণ বলে মনে করে থাকি, কিন্তু এতে তাপক্লেশের মূল কারণটাকেই এড়িয়ে যাওয়া হয় - শুধু তাপমাত্রা বৃদ্ধি তাপক্লেশের মূল কারণ নয়, মূল কারণ হলো তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা বৃদ্ধির সম্মিলিত যোগফল। বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতার বৃদ্ধি তাপক্লেশকে বাড়িয়ে তোলে যদিও এই বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই আড়ালে থেকে যায়— এটা হলো আর্দ্র-তাপ প্রবাহ যা শুষ্ক-তাপ প্রবাহের তুলনায় অনেক বেশি মারাত্মক।
আমরা জানি তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ হলো জ্বালানি হিসাবে কয়লা পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। জীবাশ্ম জ্বালানিকে নবীকরণ যোগ্য জ্বালানি যেমন সৌর, জল, হাওয়া ইত্যাদি নবীকরণ যোগ্য শক্তি দিয়ে প্রতিস্থাপিত না করা পর্যন্ত উষ্ণায়ন থেকে মুক্তি নেই। এখানে মূলত দেশের সরকারগুলির ভূমিকা যা আশানুরূপ হচ্ছে না। মুক্তি নেই বর্ধনশীল তাপমাত্রা এবং তাপপ্রবাহ থেকে। ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলা তাপমাত্রা এবং তাপপ্রবাহকে আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাব যে, শহর - নগর এবং গ্রামের তাপমাত্রায় তফাৎ হচ্ছে। গ্রামের তুলনায় শহরের তাপমাত্রা বেশি থাকছে, শহরগুলো যেন একেকটা তাপদ্বীপে পরিণত হয়েছে। শহুরে তাপদ্বীপকে প্রশমিত করা এবং এর স্বাস্থ্যজনিত কুফলকে প্রতিহত করাই এই সময়ের চ্যালেঞ্জ।
তাপপ্রবাহের মানদণ্ড
'ইন্ডিয়া মিটিওরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট'এর ঘোষণা অনুসারে যদি কোনও এলাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা সমতল অঞ্চলের জন্য কমপক্ষে ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং পাহাড়ি অঞ্চলের জন্য কমপক্ষে ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য ৩৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হয় তাহলে তা 'হিট ওয়েভ’ বা 'তাপ প্রবাহ হিসাবে বিবেচিত হয়। এরসাথে আরও কিছু মাণদণ্ড আছে। 'আইএমডি'র 'হিট ওয়েভ' বা 'তাপ প্রবাহ' ঘোষণার মাণদণ্ডে শুধুই তাপমাত্রার ম্যাট্রিক্স, 'রিলেটিভ হিউমিডিটি' বা 'আপেক্ষিক আর্দ্রতা'র ম্যাট্রিক্সটাই নেই।
উষ্ণতা বাড়ছে বিশ্বের
বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগামী ৫০ বছর পরে বিশ্বের ৩০০ কোটি মানুষ সাহারা মরুভূমির মতো জলবায়ুতে বাস করবেন। তাঁরা বলছেন যে, এমন অবস্থা ১ লক্ষ বছর আগের পৃথিবীতে ছিল। 'হিউম্যান ক্লাইমেট নিচ' বা 'জলবায়ু উপযোগী মনুষ্য আবাসস্থল' সুরক্ষাবলয় হলো ১১-১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের তাপীয় পটি বা ব্যান্ড। বর্তমানের যা অবস্থা তাতে এই সুরক্ষার তাপীয় পটিটাই ভেঙে পড়ার আশঙ্কা! কি হবে মনুষ্য প্রজাতির? এখান থেকেই আসে ষষ্ঠ প্রজাতি বিলোপের কথা। 'আইপিসিসি ' বলছে শীতল দিন এবং রাতের সংখ্যা কমছে। সার্বিকভাবে উষ্ণ দিন এবং উষ্ণ রাতের সংখ্যা বাড়ছে।
রাতের উষ্ণতা বাড়ছে
'গ্লোবাল চেঞ্জ বায়োলজি'র গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানীরা বলছেন ১৯৮৩- ২০১৭ পর্যন্ত বিশ্বের অর্ধেক ভূমিপৃষ্ঠে দিনের তুলনায় রাতের উষ্ণতা বেড়েছে ০.২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে। বলছে এর কারণ হলো, বায়ুমণ্ডল সিক্ত হওয়া বা জলীয় বাষ্পের বৃদ্ধি পাওয়া। বায়ুমণ্ডল যত উষ্ণ হবে ততই জলীয় বাষ্প ধরে রাখবে আর জলীয় বাষ্প তাপ ধরে রাখে।
মানুষ উষ্ণ শোণিত প্রাণী। মানবদেহের অভ্যন্তরস্থ সুস্থিত তাপমাত্রা হলো ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৩৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। বিশ্ব উষ্ণায়নে যেভাবে গড় তাপমাত্রা বাড়ছে তাতে শরীরের এই সুস্থিত তাপমাত্রা বজায় রাখার নিজস্ব স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি (থার্মোরেগুলেটরি মেকানিজম) চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। রাতে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বিশেষত ঘুমের ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়ছে। গবেষণায় জানা যাচ্ছে ঘুমের জন্য আদর্শ পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রার পরিসর হলো ২০- ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। স্বাভাবিকের থেকে উষ্ণতর রাতে এই 'থার্মোরেগুলেটরি মেকানিজম' বাড়তি তাপমাত্রাকে প্রশমিত করে ঘুমের উপযোগী তাপমাত্রায় পরিণত করার ক্ষেত্রে অসফল হয়, ফলতঃ ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। 'সাইন্স অ্যাডভান্সেস- ২০১৭'তে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয় তাতে বলা হয় ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বাড়লে মাসে তিন দিন ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। অসুরক্ষিত শ্রমিকের কর্মজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে এরফলে।
তাপক্লেশের পরিমাপক 'হিট ইনডেক্স' এবং 'ওয়েটবাল্ব টেম্পারেচার'। 'হিট ইনডেক্স' বা 'তাপ সূচক'কে আপাত তাপমাত্রাও বলা হয়, অর্থাৎ প্রকৃত তাপমাত্রা নয়। তাপ সূচক হলো বাতাসের তাপমাত্রা এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতার সম্মিলিত ফল যা মানুষের শরীরে মনে হওয়া বা 'ফিল লাইক' তাপমাত্রার নির্দেশক। 'ওয়েটবাল্ব টেম্পারেচার' সেই অবস্থাকে সূচিত করে যখন একজন মানুষ কিছুতেই আর ঘামের বাষ্পীভবনের মাধ্যমে শরীরকে শীতল করতে পারে না, ফ্যান চালিয়েও আরাম অনুভূত হয়না— বাতাস তখন জলীয় বাষ্পে সম্পৃক্ত তাই শরীরের ঘাম বাষ্পীভূত হতে পারে না, শরীর শীতলও হতে পারে না। এই অবস্থাটা মারাত্মক। 'ওয়েট বাল্ব টেম্পারেচার' এর উর্ধ্বসীমা হলো ৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, এই তাপমাত্রায় কয়েক ঘণ্টা টানা কাজ করলে জীবনের আশঙ্কা থাকে।
শহুরে তাপদ্বীপ
যখন শহরের তাপমাত্রা লক্ষণীয়ভাবে পার্শ্ববর্তী গ্রামীণ এলাকার তুলনায় উষ্ণতর হয় ও শহরে একটা তাপদ্বীপের মতো অবস্থা তৈরি হয় তখন তাকে ‘আরবান হিট আইল্যান্ড' বা শহুরে তাপদ্বীপ বলে। দ্রুত এবং অপরিকল্পিত নগরায়ন, জমির চরিত্র বদল, জমির আবরণের বদল শহুরে তাপদ্বীপের জন্য দায়ী। মূলত বাড়ি-ঘর নির্মাণ, রাস্তা- ফুটপাত ইত্যাদি নির্মাণের উপাদান-সরঞ্জাম তাপ শোষণ করে ধরে রাখে, শহরের পৃষ্ঠদেশকে অভেদ্য আবরণে আবৃত করে এবং মৃত্তিকার জল বাষ্পীভূত হয়ে শীতল হতে দেয় না। এ ছাড়া গাছপালা কেটে ফেলার দরুন প্রস্বেদন ক্রিয়ার মাধ্যমে বাতাসে জলীয় বাষ্প নির্গত না হতে পারা, জলাভূমি ভরাট করার ফলে জল বাষ্পীভূত হয়ে বায়ু শীতল হতে না পারা, যানবাহন ও তাপ উৎপাদক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, এয়ারকন্ডিশনিং মেশিন ইত্যাদির কারণে শহরাঞ্চল একেকটা তাপদ্বীপের অবস্থায় পরিণত হয়। শহরে নীল সবুজ পরিকাঠামো বৃদ্ধি, ছাদ বাগান, সবুজ দেওয়াল (গাছপালার), ফুটপাতে সবুজের আচ্ছাদন, মাঝে মাঝে ফোয়ারা ব্যবস্থা, ফুটপাতকে সবুজের আচ্ছাদনে জল প্রবেশ্য করা, শহুরে সবুজ পটি, জলাভূমি, প্রচলিত কংক্রিট নির্মাণের দ্রব্যগুলিকে কম তাপ ধারক দ্রব্য দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা, শক্তির যুক্তিযুক্ত ব্যবহার করা, হাওয়ার গতিপথ ইত্যাদি মাথায় রেখে গৃহনির্মাণ— এই বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে সামগ্রিক নগর পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।
'সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যা ন্ড এনভায়রনমেন্ট' এর সমীক্ষা অনুযায়ী চেন্নাইয়ে নির্মাণ পরিসর ৩০.৭% থেকে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে ৭৩.৫% হয়েছে। ২০২৩ সালে একই সময়ে সবুজের আবরণ ১৪% কমেছে। কলকাতার নির্মাণ পরিসর ২০০১ এ ছিল ৭০%, ২০২৩ এ হয়েছে ৮০.১%, অপরদিকে সবুজের আচ্ছাদন ২০১১- ২০২১ পর্যন্ত ৩০% কমেছে। পরিত্যক্ত জমি যা 'বাফার অঞ্চল' বলে বিবেচিত হতো তার পরিমাণ ২০০১ এ ৯.৮% থেকে কমে ২০২৩ এ ৩.৪% হয়েছে। জলাভূমি এই সময়ে অর্ধেকেরও বেশি কমে ৫.১% থেকে ১.৯% হয়েছে - এগুলিই কারণ শহুরে তাপদ্বীপের।
স্বাস্থ্যের ওপর আঘাত
২০২৪ সালে ভারত সরকারের স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় লোকসভায় জানায় যে ১ মার্চ থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত ৩৭৪ জনের মৃত্যু হয় এবং ৬৭ হাজারেরও বেশি মানুষ 'হিট স্ট্রোকে' আক্রান্ত হয়েছেন বলে মনে করা হয়। বেসরকারি সংস্থা 'হিট ওয়াচ' এর তথ্য অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ৭৩৩ জন। সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যা ন্ড এনভায়রনমেন্ট (সিইসি), দিল্লি জয়পুর কলকাতা নাগপুর পুনে আমেদাবাদ হায়দরাবাদ চেন্নাই ভুবনেশ্বরকে নিয়ে গবেষণা করে বলেছে যে, ৮০ শতাংশ শহরাঞ্চলে বারেবারে মারাত্মক তাপ ৫ কোটির বেশি মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে যা হার্ট সংক্রান্ত অসুখকে ত্বরান্বিত করছে। উচ্চ তাপমাত্রার জন্য প্রাণঘাতী রোগ ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ওয়েস্ট নীল ভাইরাস নতুন নতুন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। উষ্ণ এবং শুষ্ক আবহাওয়ায় বালি এবং ধূলি ঝড় হচ্ছে, ফলে তাতে আরও ৩১ শতাংশ মানুষের শরীরে বাতাসে ভাসমান কণিকার ঘনত্ব বেড়ে যাচ্ছে। তীব্র খরায় মানুষ মারাত্মক মরুঝড়ের সম্মুখীন হচ্ছে যা ২০০৩-২০০৭ এর তুলনায় ২০১৮-২০২২ এ ৪৮ শতাংশ বেড়েছে।
উৎপাদনশীলতার উপর প্রভাব
তাপের অর্থনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে তাপের কারণে শিল্পে ৫-১০% উৎপাদনশীলতা কমবে বলে জানাচ্ছে ইউএনএফসিসিসি। আইএলও’র হিসাব অনুযায়ী ভারতে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫.৮% কাজের ঘণ্টা কমে যাবে যা ৩ কোটি ৪০ লক্ষ পূর্ণ সময়ের কাজ এবং গোটা বিশ্বের ৮ কোটি শ্রমিকের কাজ চলে যাবার সমতুল। বিশ্বব্যাঙ্কের হিসাব অনুযায়ী ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বাড়লে ২% আর্থিক কর্মকাণ্ড কমে যায়।
বৈদ্যুতিক শক্তির খরচ
শহরাঞ্চলে 'আরবান হিট আইল্যান্ড এফেক্ট' এর দরুন দিল্লি মুম্বাই কলকাতা সহ নানা শহরে তীব্রভাবে চাপ বাড়ছে। বাড়ছে এসি, ফ্যান, কুলার এর অত্যধিক ব্যবহার, বাড়ছে বিদ্যুতের খরচ, বাড়ছে বিদ্যুৎ বণ্টন ব্যবস্থার উপর চাপ। এর সাথে বাড়ছে বাতাসে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমণ। 'ইন্ডিয়া কুলিং অ্যাকশন প্ল্যান ২০১৯' মোতাবেক 'থার্মাল কম্ফর্ট ফর অল' ঘোষিত হয়েছিল কিন্তু এই উচ্চাশী পরিকল্পনা শুধু কাগজে কলমেই থেকে গেছে। বিশ্বব্যাঙ্কের বিশ্লেষণ বলছে ২০৩৭ সালের মধ্যে ভারতে শীতলতার প্রয়োজন ৮ গুণ বেড়ে যাবে— প্রতি ১৫ সেকেন্ডে একটি করে এসি মেশিন বসবে। সামনের দুই দশকের মধ্যে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমণ ৪৩৫ শতাংশ বেড়ে যাবে।
জলবায়ু ঝুঁকি সূচক
'জার্মানওয়াচ' নামের সংস্থা 'গ্লোবাল ক্লাইমেট ইনডেক্স' প্রকাশ করেছে। এতে ২০২৫ সালে ভারতের স্থান ১৯৯৩-২০২২ সাল পর্যন্ত বিশ্বের সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে ৬ নম্বরে। ডোমিনিকা, চীন, হন্ডুরাস, মায়ানামার, ইতালির পর ষষ্ঠ স্থানে ভারত। ১৯৯৩-২০২২ পর্যন্ত ৭ লক্ষ ৬৫ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৪.২ ট্রিলিয়ন ইউএসডি, ৯৪০০ টি চরম আবহাওয়াজনিত ঘটনা ঘটেছে। ‘ইন্ডিয়া মিটিরিওরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট'এর তৈরি 'দ্য ক্লাইমেট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি আটলাস অব ইন্ডিয়া' বলছে, দেশে ৩০% জেলা এবং ৪১% মানুষ আক্রান্ত হবে, যার মধ্যে ৫ কোটি ৫৯ লক্ষ হলো শহুরে মানুষ।
নোটিফায়েড বিপর্যয় নয়
ভারত সরকার সমস্ত রাজ্যকে তাপ প্রবাহ মোকাবিলায় 'হিট এ্যাকশন প্ল্যান' তৈরি করার নির্দেশিকা জারি করেছে, তাপ প্রবাহের তীব্র ক্ষতির কথা সংসদে বলছে, তাপ প্রবাহ প্রশমনে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করছে, কিন্তু তাপ প্রবাহকে 'ডিজাস্টার' বা বিপর্যয় বলে নোটিফিকেশন জারি করছে না। ফলে তাপ প্রবাহজনিত বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে 'ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট - ২০০৫' এর আওতাধীন আর্থিক সহায়তা পাওয়া যায় না। 'ইন্ডিয়া মিটিওরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট' বলছে ২০২৪ সালে ৫৩৬টি তাপ প্রবাহ দিন ছিল - ১৪ বছরের মধ্যে যা সর্বাধিক। সম্প্রতি বিপর্যয় বলে যে তালিকা প্রকাশ করেছে 'ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফান্ড' এবং 'স্টেট ডিজাস্টার রেসপন্স ফান্ড', তাতে নানা বিপর্যয়ের নাম আছে কিন্তু তাপ প্রবাহের নাম নেই। নাম আছে সাইক্লোন খরা ভূমিকম্প আগুন বন্যা সুনামি তুষারপাত ভূমিধ্বস তুষারধ্বস মেঘভাঙা বৃষ্টি পতঙ্গের আক্রমন শৈত্য প্রবাহ হিমানী প্রবাহ। কিন্তু তাপপ্রবাহ গ্রাহ্য হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকারকে তাপ প্রবাহকে বিপর্যয় হিসাবে ঘোষণা করে নোটিপিকেশন জারি করতে হবে— এ দাবি খেতমজুর, কৃষক, শ্রমিক এবং সার্বিকভাবে অসুরক্ষিত জনগণের দাবি। এ দাবি আদায় করতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীনতাও প্রকট। এরাজ্যের 'হিট ওয়েভ অ্যাকশন প্ল্যান' একেবারেই অকার্যকর এক পরিকল্পনা। তাপ প্রবাহের সময় 'কি কি করিতে হইবে' এবং 'কি কি করিবেন না’ জাতীয় উপদেশাবলীতেই তা সীমাবদ্ধ। তাপ প্রবাহের বিরাট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পরিপ্রেক্ষিতে তা নিতান্তই শিশুসুলভ।
হিট ওয়েভ ইনসিওরেন্স
অসুরক্ষিত শ্রমিকদের তাপ প্রবাহের প্রভাবে জীবিকা ও স্বাস্থ্য রক্ষার প্রশ্নে তাপ প্রবাহ বিমার চাহিদা বাড়ছে। একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় পৌঁছালে বা কয়েকদিন ধরে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বিরাজমান থাকলে শ্রমিকদের বিমাজাত নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করা হয়। এই বিমার মাধ্যমে প্রদান করা অর্থের পরিমাণ শ্রমিকদের দৈনিক মজুরির ওপর ভিত্তি করে হয়। সেল্ফ এমপ্লয়েড উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশন ভারতের কতকগুলো রাজ্যে 'হিট ওয়েভ ইনসিওরেন্স' কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তাদের দাবি, দেশে ৩ টি রাজ্যের ২২টি জেলার ৭ টি শিল্পক্ষেত্রের ৪৬ হাজার মহিলা শ্রমিক বিমার সুবিধা গ্রহণ করছে। এই বিষয়টি সরকারি উদ্যোগেই করতে হবে। স্বাস্থ্যবিমার দাবি নিয়ে যেমন শ্রমিক, ফসল বিমার দাবি নিয়ে যেমন কৃষক লড়াই করে, তাপ প্রবাহ বিমার দাবি নিয়ে তেমনই সমগ্র মেহনতি মানুষের লড়াই গড়ে তুলতে হবে।
কেরালা সরকারের পদক্ষেপ
কেরালা সরকার ২০২৫সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নোটিফিকেশন জারি করে বহিরঙ্গন শ্রমিকদের কাজের ঘণ্টা এবং বিশ্রামের সময় বেঁধে দিয়েছে। কাজের সময়কাল কমিয়ে সকাল ৭টা-সন্ধে ৭টা র মধ্যে ৮ ঘণ্টা কাজের সময় বেঁধে দিয়েছে। দুপুর ১২টা - ৩টে পর্যন্ত বিশ্রামের সময় রাখা হয়েছে। দেখভালের জন্য নির্দিষ্ট টিম গঠন করা হয়েছে যারা পরিদর্শন করবে বিশেষত ঘরবাড়ি নির্মাণ এবং রাস্তা নির্মাণের ক্ষেত্রে। ৩ হাজার ফুটের উপরে এই নির্দেশিকায় ছাড় আছে। 'কেরালা স্টেট ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটি' গিগ শ্রমিকদের তাপ প্রবাহের ক্ষেত্রে কোম্পানির মালিকদের উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশ পাঠিয়েছে। কেরালা সরকারের এই ইতিবাচক পদক্ষেপকে দেশের সব সরকার তথা কেন্দ্রীয় সরকারকে মানতে বাধ্য করার জন্য শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজন আছে।
মানবাধিকার কমিশনের চিঠি
২০২৫ সালে পয়লা মে, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে দেশের ১১টা রাজ্যকে এই গ্রীষ্মে তাপ প্রবাহ থেকে অসুরক্ষিত (ভালনারেবল) মানুষজনকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছে। পশ্চিমবঙ্গ সহ ১১টি রাজ্যের মুখ্য সচিবকে চিঠি দিয়ে ছাউনির ব্যবস্থা, ত্রাণ, কাজের ঘন্টার সংশোধন, তাপ প্রবাহ জনিত অসুস্থতায় চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে বলা হয়েছে। রাজ্যগুলি হলো পাঞ্জাব হরিয়ানা উত্তর প্রদেশ বিহার ঝাড়খণ্ড পশ্চিমবঙ্গ ওডিশা অন্ধ্র প্রদেশ তেলেঙ্গানা মহারাষ্ট্র এবং রাজস্থান।
তাপ প্রবাহ প্রশমন এবং মোকাবিলার লড়াই আজ শুধু জনবিজ্ঞান কর্মীদের লড়াই নয়, এ লড়াই সার্বিকভাবে মেহনতি মানুষের রুটি রুজি ও জীবন সংগ্রামের লড়াই, মেহনতি মানুষের শ্রেণি সংগ্রামের সাথে সম্পৃক্ত এই লড়াই। শ্রমজীবী মানুষকেই এই লড়াই লড়তে হবে এবং সমগ্র মানব সমাজকে কঠিন সঙ্কট থেকে মুক্ত করতে হবে।
Comments :0