Anko ki Kathhin

কঠিন অঙ্ক সহজে কষল সৌরভ

বিশেষ বিভাগ

ঋদ্ধি রিত


অঙ্ক কি কঠিন
পরিচালনা: সৌরভ পালধি
অভিনয়: ঋদ্ধিমান বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতশ্রী চক্রবর্তী, তপোময় দেব, প্রসূন সোম, পার্নো মিত্র, শঙ্কর দেবনাথ, সঞ্জিতা, উষসী চক্রবর্তী, দীপান্বিতা নাথ 

জীবন যুদ্ধের সহজ এক গল্প বলে সৌরভ পালধীর ‘অঙ্ক কি কঠিন’। এই সময়ে দাঁড়িয়ে একটু সতেজ বাতাসের মতো ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে সাজানো গোছানো শহুরে ঝা চকচকে মাদকতার বদলে, পরিচালক খুঁজেছেন বিপরীত দিক। বড় ইমারতের ছায়ায় ঢাকা পড়া শহরেরই এক বস্তির গল্প। আরও খুঁটিয়ে বললে তিন বন্ধু বাবিন (ঋদ্ধিমান বন্দ্যোপাধ্যায়), ডলি (গীতশ্রী চক্রবর্তী) আর টায়ার (তপোময় দেব)—  এই তিন স্কুলছুটের অভিযানের গল্প। যারা স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখায়। সেই অর্থে তারকাবিহীন সিনেমায়, তারকা এই তিন খুদেই। সহজ সাবলীল ও প্রাণবন্ত অভিনয়ে যারা ছবির শেষ পর্যন্ত দর্শককে মাতিয়ে রাখে।
‘ঝরঝরে’ সরকারি স্কুলের পড়ুয়া ছিল বাবিনরা। করোনা অতিমারীর পর সারা রাজ্যের প্রায় আট হাজার সরকারি প্রাথমিক স্কুল বন্ধ হয়েছে। তেমনই এখন বন্ধ বাবিনদের স্কুলও। তবে, তারা তিনজন স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেনি। নিজেরাই ঠিক করে নিয়েছে বাবিন হবে ডাক্তার, ডলি নার্স আর টায়ারের স্বপ্ন ইঞ্জিনিয়ার। অতিমারীর দাপট কমার পরেও বদলায়নি ছবি। বরং বেড়েছে মানুষের কষ্ট। এই আবহে তাদের ইচ্ছে একটা হাসপাতাল খুলবে। স্কুল বন্ধের পর নিজেদের স্বপ্ন বুকে করে এলাকারই এক পরিত্যক্ত নির্মীয়মাণ বহুতলে তারা বানিয়ে তোলে তাদের আশ্চর্য এক হাসপাতাল। তাদের ‘আব্বুলিশ বাড়ি’-তে কেবল একটা জরাজীর্ণ বাথটবে ঠেকনা পেওয়া খাট, সাদা কালো টিভি, কিছু চেয়ার আর জোড়াতালি দিয়ে বানানো আলমারি নিয়ে তৈরি সেই হাসপাতালে আছে কুড়িয়ে পাওয়া কাঁচি, খুঁজে আনা স্টেথো, আর চুরি করা (আদতে নয়) অক্সিজেন সিলিন্ডার। 
তিন বন্ধুর সবচেয়ে বড় ভরসা হলো তাদের শাহরুখ’দা (প্রসূন সোম)। খাবার ডেলিভারি করা এলাকার এই মুসলিম যুবকেরও একসময় স্বপ্ন ছিল পাইলট হবার। সেই স্বপ্ন পূরণ না হলেও, সে ‘হিন্দি সিনেমার স্বপ্নের জুটি’ গড়েছে এই গল্পে। সর্ষে খেতের বদলে শহরের বিভিন্ন জলাভূমির ধার ধরে এঁকেবেঁকে যাওয়া ফিতের মতো লম্বা রাস্তার বুক চিরে শাহরুখ সাইকেল চালিয়ে যায় তার প্রেমিকা হিন্দু বাড়ির মেয়ে কাজলের (পার্নো মিত্র) সঙ্গে দেখা করতে। এই গল্পের কাজল নার্সের কাজ করে। এই জুটি হিন্দি সিনেমার প্লটের উল্টোদিকে গিয়েও গোটা সিনেমার ভর কেন্দ্রে থাকা শাহরুখ বাবিনদের কাজে হাত বাড়ায়। সে ওষুধের দোকান থেকে ধার করে অক্সিজেন মাস্ক কিনে দেওয়াই হোক বা তাদের হাসপাতালের বাল্ব বদলে দেওয়া। তিন খুদের সঙ্গে, প্রসূন সোমের (শাহরুখ’দা) অভিনয় অবশ্যই নজর কাড়তে বাধ্য। ছোটদের সঙ্গেই হোক বা পার্নো মিত্রের সঙ্গে তাঁর অসাধারণ রসায়ন, কখনও আলসেমি আসতে দেয়নি।
বাবিনের বাবার ভূমিকায় শঙ্কর দেবনাথ এক্কেবারে মানানসই। দিনমজুর খাটা রাজমিস্ত্রি বাবা ছোট্ট ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাতে একা বসে থাকে এক টোটোয়। হাজার স্বপ্ন ভিড় করে আসে বাবার চোখে, যা ফুটে ওঠে টোটোর ভিতরে লাগানো ঝিকিমিকি রঙিন আলোয়। এইরকম এক চরিত্র, এইভাবে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে শঙ্কর দেবনাথ অনন্যতা দেখিয়েছেন। মঞ্চে যেভাবে দৃঢতার সঙ্গে নিজেকে ফুটিয়ে তোলেন, পর্দাতেও তাই। তাঁর মতো শক্তিশালী অভিনেতাকে বাংলা সিনেমায় আরও বেশি ব্যবহার করা (বড় চরিত্রে) খুবই প্রয়োজন। 
বাবিনের গৃহকর্মী মায়ের চরিত্রে রয়েছেন সঞ্জিতা। ডলির মা নার্স, সেই চরিত্রে উষসী চক্রবর্তী ও টায়ারের মা যৌনকর্মী (পেটের দায় শরীর বিক্রি করে), তার চরিত্রে দীপান্বিতা নাথ বেশ মানানসই। খুদেদের সঙ্গে তাদের পারিবারিক মুহূর্তগুলিও খুবই আবেগময়। অন্যদিকে নার্সের ভূমিকায় পার্নো মিত্র খুবই সাবলীল। বাস্তবতা তুলে ধরা গল্পের মধ্যে মন ভালো করার আলতো ছোঁয়া দিয়ে গেছে তাঁর অভিনীত কাজলের চরিত্র। পার্নো আগেও নিজের অভিনয়ে দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন।
সেই অর্থে তারকাবিহীন সিনেমায়, থিয়েটারের অভিনেতাদের মুখের ভিড়। বিশেষ এক চরিত্রে দেখা দিয়েছেন দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। ছোট এক চরিত্রে চোখ টানবে কৃষ্ণেন্দু সাহার অভিনয়। তিন খুদেও থিয়েটারের। এমনকি সিনেমার পরিচালকও। 
রুলবুকের জীবনে নিজেদের স্বপ্নপূরণ করতে লাগে সাহস আর অদম্য ইচ্ছে। সেই ইচ্ছেকেই সম্বল করে অঙ্ক সহজ করল তিন বন্ধু। ‘ছোটদের সিনেমা’ হলেও কঠিন বাস্তবতার অঙ্কই তুলে ধরেছেন সৌরভ। যার খুব সহজে সমাধান হয় না। বড় জটিল সে অঙ্কের সঙ্গে ছোটবেলায় করা কেসি নাগের তেল মাখা বাঁশে বাঁদরের ওঠা আর নামার অঙ্কের সঙ্গেই মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তবে, সেই অঙ্কে যেমন মজাও ছিল, এই গল্পেও মজা আছে, স্যাটায়ারও। সৌরভ নিজেও মনে করে, ‘‘এই ছবি যখন ছোটরা দেখতে আসবে, তাঁদের সঙ্গে আসবেন মা-বাবারা। তাঁরা যেন বাড়ি গিয়ে নিজেদের বোঝাতে পারেন, তোমরা সবকিছু পাচ্ছো মানে এই সমাজের সবাই সব পাচ্ছে তা নয়। সবাই প্রিভিলেজ নয়।’’
সিনেমার সংলাপে সৌরভ নিজের ছাপ রেখেছেন। তবে মাঝেসাঝে দু’-এক জায়গায় সামান্য বাড়তি মনে হয়, যা সিনেমার গতি কিছুটা শ্লথ করেছে। এডিটিংয়ে প্রণয় দাশগুপ্তর কাজ এককথায় ভালো। কিছু ক্ষেত্রে আবহ বেশি মনে হলেও ‘আমাকে গল্প বল’ আর ‘চাপ নিয়ে লাভ নেই’ দুই বিপরীত ধরনের গানের জন্য সমান প্রশংসা আদায় করে নেবে দেবদীপ মুখার্জি। আর, তাঁর সরদের মূর্ছনায় ‘একটা গল্প বল’ এক অদ্ভুত অনুরণন তৈরি করে। পূর্ণেন্দু পত্রী লিখেছেন, ‘‘সরদ জানে পুরুষের কান্না’’। এখানে সৌরভ আর দেবদীপের যুগল বন্দিতে সরদ জানালো মানুষের কান্না।  
 

Comments :0

Login to leave a comment