প্রতিনিধি: নয়াদিল্লি, ২২ জানুয়ারি— বিবিসি’র তথ্যচিত্র ভারতে ইউ টিউব এবং টুইটারে আটকে দেবার পরেও ওই তথ্যচিত্রে ওঠা অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করলেন গুজরাট গণহত্যার সময়ে ব্রিটেনের বিদেশ মন্ত্রী থাকা জ্যাক স্ট্র।
বিবিসি টু টেলিভিশনের ‘ইন্ডিয়া: দি মোদী কোয়েশ্চেন’ নামের এই তথ্যচিত্রের প্রথম পর্ব সম্প্রচারিত হয়েছে গত মঙ্গলবার। এই তথ্যচিত্রে গুজরাট গণহত্যার সময়ে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভূমিকা সম্পর্কে সমালোচনা থাকায় একাধিক ইউ টিউব ভিডিও প্রচার ব্লক করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এমনকি ইউ টিউবের লিঙ্ক থাকায় ৫০টির বেশি টুইটার পোস্ট ব্লক করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংবাদসংস্থার খবর, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের সচিব অপূর্ব চন্দ্র এই নির্দেশিকা পাঠিয়েছেন। টুইটার ও ইউ টিউব এই নির্দেশিকা মেনেও নিয়েছে বলে জানা গেছে। এই ঘটনাকে ‘সেন্সরশিপ’ বলেই অভিহিত করেছেন বিরোধীরা।
এর মধ্যেই ‘দি ওয়্যার’ ওয়েবসাইটে বিশিষ্ট সাংবাদিক করণ থাপরকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ওই সময়ের ব্রিটিশ বিদেশ মন্ত্রী জ্যাক স্ট্র। স্ট্র বলেছেন, ২০০২-এ গুজরাট গণহত্যার পরে ভারতের ব্রিটিশ হাইকমিশন লন্ডনের বিদেশ মন্ত্রকে রিপোর্ট পাঠিয়ে বলেছিল, গুজরাট গণহত্যার জন্য নরেন্দ্র মোদী প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। স্ট্র’র মন্তব্য, ওই সময়ে যারা ঘটনার বিশদ জানতেন তাঁদের অনুভূতি তা-ই ছিল। স্ট্র স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন, হাইকমিশনের রিপোর্টে বলা ছিল ২৭ ফেব্রুয়ারি নরেন্দ্র মোদী উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে বসে তাঁদের নির্দেশ দিয়েছিলেন দাঙ্গায় যেন তাঁরা হস্তক্ষেপ না করেন।
এই অভিযোগটি দীর্ঘদিনের। নানা অনুসন্ধানেই এই কথা উঠে এসেছে। স্বভাবতই নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপি পরে তা অস্বীকার করেছে। ব্রিটিশ হাইকমিশনও যে একই অভিযোগ করেছিল, এই তথ্য অবশ্য এভাবে সামনে আসেনি।
স্ট্র বলেছেন, রিপোর্টে বলা হয়েছিল গুজরাট হত্যাকাণ্ডে এক জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার সমস্ত লক্ষণ স্পষ্ট। এর ফলে আমি খুবই উদ্বিগ্ন বোধ করি। এই রিপোর্ট পেয়ে আমি বাজপেয়ী সরকার এবং ভারতের তদানীন্তন বিদেশ মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলি। উল্লেখ্য, তখন ভারতের বিদেশ মন্ত্রী ছিলেন যশোবন্ত সিং।
বিবিসি’র তথ্যচিত্রে ব্রিটিশ সরকারের এযাবৎ অপ্রকাশিত এই রিপোর্ট উল্লেখ করা হয়েছে। তার অংশ দেখানো হয়েছে। জ্যাক স্ট্র’র মন্তব্যও রয়েছে। ‘দি ওয়্যার’-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে স্ট্র তার সত্যতা স্বীকার করেছেন। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘যে খবর প্রকাশিত হয়েছে হিংসার পরিমাণ তার থেকে অনেক বেশি’। বলা হয়েছে, ‘মুসলিম নারীদের ব্যাপকভাবে এবং পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে।’ ওই হিংসা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং হিন্দু এলাকা থেকে মুসলিমদের হটিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে। তথ্যচিত্রে অভিযোগ করা হয়েছে, ‘নিঃসন্দেহে তা মোদীর নির্দেশে হয়েছে।’ স্ট্র করণ থাপারকে বলেছেন, হ্যাঁ, রিপোর্টে তা-ই বলা হয়েছিল।
ভারত সরকারের তরফে প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও এই তথ্যচিত্র ‘গভীর ভাবে গবেষণার’ পরে তৈরি বলে দাবি করেছে বিবিসি। বিবিসি’র তরফে বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ সম্পাদকীয় মাপকাঠিকে মান্যতা দিয়ে গভীর গবেষণার পরে ওই তথ্যচিত্র তৈরি করা হয়েছে। ব্যাপক অংশের কণ্ঠস্বর, সাক্ষ্য, বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া হয়েছে। অনেক ধরনের অভিমত রয়েছে। তার মধ্যে বিজেপি’র সঙ্গে যুক্তদের মতামতও রয়েছে। ওই তথ্যচিত্রে উত্থাপিত বিষয়ে তাদের জবাব দেবার জন্য ভারত সরকারকেও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা উত্তর দিতে অস্বীকার করে।
বিবিসি তথ্যচিত্রে নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন বিরোধীরা। সামাজিক মাধ্যমেও তারা প্রশ্ন তুলেছেন, বিবিসি’র তথ্যচিত্রে ভুল তথ্য থাকলে তার জবাব না দিয়ে তা নিষিদ্ধ করা হচ্ছে কেন। এদিন বরিষ্ঠ সাংবাদিক পি সাইনাথ বলেছেন, ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া বিষাক্ত, নিচ। মোদী, তাঁর সরকার, তাঁর দল সম্পর্কে যে কোনও সমালোচনা ওরা মুছতে চাইছে। সাইনাথ আরও প্রশ্ন তুলেছেন, ভারতের মিডিয়া চুপ কেন? এ তো নিজেকেই নিজে সেন্সর করা।
Comments :0