Editorial

ফের অগ্নিগর্ভ মণিপুর

সম্পাদকীয় বিভাগ

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্বাদের ডাবল ইঞ্জিনের সরকার থাকা মণিপুরে গোলমাল দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক মহলের আশঙ্কা যে কোনও সময় সেটা বিকল হতে পারে বা লাইনচ্যুত হতে পারে। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে মোদী-শাহরা উত্তরপূর্ব ভারতের এই রাজ্যটিতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির স্বার্থে বিভাজনের যে খেলা শুরু করেছেন তার ভয়ঙ্কর পরিণতির শিকার আজ মণিপুরের মানুষ। কেবলমাত্র ভোটে জেতা এবং ক্ষমতা দখলের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই জনগোষ্ঠী এবং সংখ্যালঘু কুকি-জো আদিবাসীদের মধ্যে বিষ ছড়িয়ে, নানা ছক-ষড়যন্ত্র করে পরস্পরকে শত্রুতে পরিণত করে মুখোমুখি সংঘাতে নামিয়ে দিয়েছে। এই আবহে গত বছর ৩মে থেকে মারামারি, খুনোখুনি ছড়িয়ে পড়েছে গোটা রাজ্যে। ডাবল ইঞ্জিনের সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং-র পক্ষপাতদুষ্ট শাসন কুকি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সরকার বিরোধী ক্ষোভ যেমন তীব্র করেছে। তেমনি মেইতেইরাও মনে করছে সরকার তাদের স্বার্থ দেখছে না। দু’পক্ষের মধ্যে জাতি দাঙ্গার জেরে ইতিমধ্যে আড়াই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আহত-জখম বেশ কয়েক হাজার। ঘরবাড়ি ও গ্রামছাড়া হয়ে আশ্রয় শিবিরে থাকতে বাধ্য হয়েছেন প্রায় এক লক্ষ মানুষ। এমন এক অশান্ত মণিপুরে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বহর ক্রমাগত বাড়তে থাকলে ডাবল ইঞ্জিনের মুখর প্রবক্তা মোদী কিন্তু নির্বিকার। মণিপুরে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি নির্বিকার। মুখে কথার ফুলঝুরি ফুটলেও মণিপুর নিয়ে কোনও কথা নেই। দেড় বছরে একবারের জন্যও মণিপুরের মাটিতে পা রেখে সেখানকার মানুষকে আশ্বস্ত করার সময় পাননি। আসলে মণিপুর তাঁর অ্যাজেন্ডাতেই নেই।
সেই মণিপুর আবার নতুন করে সংঘাতদীর্ণ হয়ে উঠছে। সম্প্রতি বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন কেন্দ্র ও রাজ্যের উদ্যোগে দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে শান্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। শীঘ্রই মণিপুর শান্ত ও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। মুখ্যমন্ত্রীর এমন আশ্বাসবাণীর রেশ কাটতে না কাটতেই গত সপ্তাহ থেকে নতুন করে জ্বলতে শুরু করেছে অশান্তির আগুন। তবে এবারের হামলার চরিত্র অনেকটা বদলে গেছে। আগে মণিপুরে ড্রোন, রকেট লঞ্চার, ক্ষেপণাস্ত্র কখনও ব্যবহার হয়নি। এখন দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর সশস্ত্র বাহিনী এসব আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর অস্ত্র ব্যবহার শুরু করেছে। ড্রোন থেকে বোমা ফেলা হয়েছে বেশ কয়েক জায়গায়। রকেট লঞ্চারের মাধ্যমে ক্ষেপণাস্ত্র হামলাও হয়েছে। অবশ্য ড্রোন বা রকেটগুলি অত্যাধুনিক বা উন্নতমানের নয়। স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি এবং পাল্লা বেশি নয়। এতদ্‌সত্ত্বেও সংঘর্ষের এই গুণগত পরিবর্তন রাজ্যজুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রবল ভীতি ও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। পাশাপাশি ক্ষোভ বাড়তে শুরু করেছে সরকারের বিরুদ্ধে। এই অবস্থায় এতদিন কেন্দ্রে দমদেওয়া পুতুলের মত মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংও অসহায় বোধ করছেন। রাজ্য সরকার প্রকাশ্যেই স্বীকার করছে এমন আধুনিক অস্ত্রের মোকাবিলার কোনও পরিকাঠামো, সরঞ্জাম এবং দক্ষতা রাজ্য পুলিশের নেই। তাই জোট সরকারের নেতা-মন্ত্রী-বিধায়কদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করে দু’দফায় রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে অনেকটা বিরোধী দলের মুখ্যমন্ত্রীর মতো কেন্দ্রের কাছে ৮ দফা দাবি সনদ পেশ করেছেন। পাশাপাশি প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে রেখেছেন পদত্যাগের। অবশ্য তাঁর পদত্যাগের দাবি পক্ষে-বিপক্ষে সকলেই করে আসছেন অনেকদিন ধরে। মুখ্যমন্ত্রী যে দাবিসনদ পেশ করেছেন তাতে মেইতেই গোষ্ঠী সায় দিলেও কুকি-জো মেনে নেবে না। ফলে মুখ্যমন্ত্রীর এই উদ্যোগে শান্তির বাতাবরণ তৈরি হবে না। নিজের ব্যর্থতা ও অপদার্থতা আড়াল করতে কেন্দ্রে ঘাড়ে বন্দুক রেখে চমক সৃষ্টি করছেন। মেইতেই কুকিদের মধ্যে বিভাজন করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেইদের সমর্থনের ভিত শক্ত করে ক্ষমতা দখলের নেশায় মণিপুরের বুকে এই সর্বনাশ ডেকে এনেছে বিজেপি। এদের ক্ষমতাচ্যুত না করে মণিপুরে শান্তি ফেরানো সম্ভব নয়।
 

Comments :0

Login to leave a comment