FARMER SUICIDE

মাঠেই পড়ে আলু, আত্মঘাতী দুই কৃষক

রাজ্য জেলা

FARMER SUICIDE মৃত কৃষক ইসমাইল শেখের শোকার্ত পরিবার।

মাঠ থেকে আলু তোলা শুরু হতেই কৃষককের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন পূর্ব বর্ধমান ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দুই আলু চাষি। জমির আলু জমিতেই পড়ে আছে। দাম নেই। দেনার জ্বালায় আলুচাষিরা আত্মহত্যার বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। কালনার ইসমাইল শেখ এবং চন্দ্রকোনার তাপস রুইদাস গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। মৃত ইসমাইল শেখের (৫৫) বাড়ি কালনা -১ পঞ্চায়েত সমিতির অন্তর্গত বেগপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের রাজখাড়া গ্রামে। আত্মঘাতী তাপস রুইদাসের বাড়ি চন্দ্রকোনার বসনছোড়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার ভগবানবাড় গ্রামে।

 


 এই মরশুমে আলুর দাম পাচ্ছেন না কৃষকরা। ফলে চাষের খরচই উঠছে না। তাই ঋণে জর্জরিত হয়ে সোমবার বিকেলে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন ইসমাইল। মঙ্গলবার কালনা হাসপাতালে মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়। মৃতের বড় ছেলে শরিফুল শেখ জানান, বাবা ৭ বিঘা পরের জমি নিয়ে আলু চাষ করেছিলেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে সুদে টাকা নিয়ে এই আলু চাষ করেছিলেন। বর্তমান এবং পূর্বের ঋণ নিয়ে বাবার বাজারে ৭ থেকে ৮ লক্ষ টাকা দেনা হয়ে গিয়ে ছিল। ভেবেছিলেন আলু চাষ করে দেনা পরিশোধ করে দেবেন। কিন্তু ফলন এবং দাম না থাকায় উৎপাদন খরচটুকু উঠবে না জেনে বাবা চরম হতাশায় পড়েছিলেন। গত বছর অকাল বৃষ্টির কারণে দু’-দু’বার আলু লাগাতে প্রচুর টাকা খরচ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু  স্বাভাবিকের থেকে ফলন অনেক কম হওয়ায় লাভ তো দূরে থাক, উৎপাদন খরচটুকুও ওঠেনি। তাই গত বছরের  ঋণও পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। ফলে বাবার ঋণ দিন দিন সুদে-আসলে বিরাট আকার ধারণ করেছিল।


  ইসমাইল শেখের মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করতে আসা প্রতিবেশীদের প্রশ্ন করা হয়, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলছেন কৃষকের আয় তিন গুণ হয়েছে। তাহলে কৃষকরা আত্মঘাতী হচ্ছেন কেন ? এই প্রশ্নের উত্তরে প্রতিবেশীরা জানান, আমাদের গ্রামে কৃষকদের কাছে সেই আয় হয়তো এসে পৌঁছায়নি। সারা ভারত কৃষকসভার পূর্ব বর্ধমান জেলা সভাপতি সূকুল সিকদার বলেন, গত বছর নিম্নচাপের বৃষ্টির পর কৃষিপ্রধান পূর্ব বর্ধমান জেলায় দেড় শতাধিক ঋণগ্রস্ত কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন। সেই আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা এবছরও অব্যাহত। যে সমস্ত কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তাঁদের পাশে সরকার পাশে না দাঁড়ালে কৃষকদের মৃত্যু মিছিল বন্ধ হওয়া সম্ভব নয়। তাই আমরা এবছর সরকারিভাবে হাজার টাকা প্রতি কুইন্টাল আলু ও পেঁয়াজ কেনার দাবি তুলেছি। দাবি করছি আত্মঘাতী কৃষক ইসমাইল শেখের পরিবারের পাশে আর্থিকভাবে সরকার দাঁড়াক। কারণ তার পরিবারের রয়েছে স্ত্রী, তিন ছেলে মেয়ে, বৌমা এবং নাতনি।


চন্দ্রকোনার এক প্রান্তিক কৃষক তাপস রুইদাস প্রান্তিক কৃষক।  বয়স ৪২। মঙ্গলবার ভোর রাতে সবার অজান্তে বাড়ির পিছনে ভাঙা ঘরের ছাউনির কাঠামোতে দড়ি দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। সকালে প্রতিবেশীরা প্রথম দেখেন দেহ ঝুলতে। পুলিশে খবর দেন এলাকার মানুষ। মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে পাঠায় চন্দ্রকোনা থানার পুলিশ। বাড়িতে বৃদ্ধা মা, স্ত্রী সহ তিন নাবালক সন্তান রয়েছে। 


এমন ঘটনায় ভাঙা বাড়ির উঠোনে কান্নার রোল ওঠে। আর্তনাদের কান্নায় ভেঙে পড়েন প্রতিবেশীরা। বৃদ্ধা মা মালতি রুইদাস মাটিতে মাথা ঠুকে কান্না ভরা গলায় বলেন, পরের জমি চাষ করতে না বলেছিলাম। ছেলে বলল এখন মজুরের কাজ নেই, জব কার্ডের কাজ নেই। ভাঙা ঘর মেরামত সহ সংসার চালাতে তাই পরের জমি চাষ করে একটু বেশি আয়ের জন্য। এখন ছেলেটাই চলে গেল। নিজের ১২কাঠা সহ সব মিলিয়ে মোট আড়াই বিঘা জমি চাষ করেছিলেন।


ভালো ফলন ফলিয়েও মাঠেই মজুত রয়েছে সেই আলু। এখন মাঠ থেকে ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হচ্ছে ২৩০ থেকে ২৪০ টাকায়। ফসলের দাম নেই। ফড়েরা কম দামে আলু তোলার চেষ্টা করছে। তাপস রুইদাসের স্ত্রী রুম্পা রুইদাস জানান, লক্ষাধিক টাকা মহাজনী ঋণ মেটানোর চাপ ছিল। রুম্পা বলেন, আগে দশ কাঠা জমির ধান পুরোটাই বিক্রি করার সময়ও সরকারি কেন্দ্রে বিক্রির সুযোগ পায়নি তারা। মহাজনের কাছে কুইন্টাল প্রতি মাত্র ১৩০০টাকাতে সেই ধান বিক্রি করে পরের দুই বিঘা জমির চাষ করার জন্য অগ্রিম টাকা মেটায়। সার বীজ ওষুধ সহ চাষের জন্য ১ লক্ষ ১৩ হাজার টাকা মহাজনী ঋণ নিয়ে চাষ করেন। ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে সেই মহাজনী ঋণ মেটানোর চুক্তি ছিল। তা না করতে পারলে পুনরায় সুদের উপর সুদ দিতে হবে। সেই নিয়ে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। 


বৃদ্ধা মা মালতি রুইদাস বলেন বয়স্ক ভাতা থেকেও তিনি বঞ্চিত। দুয়ারে সরকার ক্যাম্পে দুইবার ধরে আবেদন পত্র সহ কাগজ পত্র জমা দিলেও বয়স্ক বা বিধবা ভাতা কোনোটাই পাননি। তফসিলি জাতি হয়েও বউমার লক্ষী ভাণ্ডার ভাতা এখনো চালু হয়নি। এক চালার ছিটে ভাঙা ঘরের মাথায় ত্রিপল চাপিয়ে ছয় জনের বাস। আবাস যোজনার বরাদ্দ থেকেও বঞ্চিত। দিন মজুর সহ নিজের ১২কাঠা জমি চাষ আর আলু চাষের সময় পরের জমি চুক্তি চাষ করেই সংসার চলতো পরিবারটির। ঢাক বাজানোর বায়না পেলে ছেলে ঢাক নিয়েও বাইরে যেতো। তাতেও সংসার চলতো না।


এই নিয়ে গত এক মাসে চন্দ্রকোনা থানা এলাকায় দুই জন কৃষক আত্মহত্যা করলেন।  

Comments :0

Login to leave a comment