সদ্য প্রকাশিত দু’টি রিপোর্টকে হাতিয়ার করে গ্রাম উন্নয়নে নিজের সরকারের সাফল্যের ধ্বজা ওড়াতে ময়দানে নেমে পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। একটি কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ও প্রকল্প রূপায়ণ মন্ত্রকের পারিবারিক ভোগব্যয় সমীক্ষা ২০২৩-২৪ এবং অন্যটি এই সমীক্ষা রিপোর্টের ভিত্তিতে তৈরি স্টেট ব্যাঙ্কের একটি রিপোর্ট। পারিবারিক ভোগব্যয় সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১১-১২ থেকে ২০২২-২৩ সালের গ্রাম-শহর সর্বত্রই মাথাপিছু ভোগ ব্যয় অনেকটা বেড়েছে। তবে এই বৃদ্ধি শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি বাড়ায় ভোগ ব্যয়ে গ্রাম-শহরের মধ্যে ব্যবধান খানিকটা কমেছে। তাছাড়া রিপোর্টে এমন দাবিও করা হয়েছে বিগত এক দশকে গ্রামের মানুষের খরচের চরিত্রও অনেক বদলে গেছে। গ্রামের মানুষ নাকি এখন তাদের মোট ব্যয়ের অর্ধেকের বেশি ব্যয় করছে খাদ্য ছাড়া অন্য খাতে। মোদীর দাবি স্বাধীন ভারতে নাকি এই প্রথম গ্রামের মানুষের খাদ্যের চেয়ে অন্য খরচ বেশি করছে। আর স্টেট ব্যাঙ্কের রিপোর্ট দাবি করেছে গত দশ বছরে নাকি ২৫ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার উপরে উঠে এসেছে। ফলে ২০১১-১২ সালে দরিদ্র জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ থেকে ২০২৩-২৪ সালে ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২৩-২৪ সালে সেটা নাকি আরও কমে ৫ শতাংশ। এই হারে যদি দারিদ্র কমতে থাকে তাহলে দু’-তিন বছরের মধ্যেই ভারত দরিদ্রমুক্ত হয়ে যাবে। অর্থাৎ মোদীর তৃতীয় দফা রাজত্ব শেষ হবার আগেই ভারতে কোনও দরিদ্র মানুষ থাকবে না। বিকশিত ভারত তথা উন্নত ভারত গড়ার কাজ প্রথম পর্ব এখনই সম্পন্ন হয়ে যাবে। অবশ্য মোদী কখনও কোনও দাবি করার দুঃসাহস দেখাননি। তবে আসন্ন দিল্লি নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটে ফায়দা লুটতে দিল্লিতেই ছয়দিনব্যাপী গ্রাম ভারত মহোৎসবের আয়োজন করে ফেলেছেন। আর সেখানে যথেচ্ছহারে নিজের সাফল্যের ঢাক পিটিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হলো মোদীরা যে সব দাবি করছেন বাস্তবের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য ঠিক কতটা। নাকি সবটাই বাস্তব বর্জিত প্রচারসর্বস্ব তথ্য। মাথাপিছু গ্রামীণ ভোগ ব্যয় ২০১১-১২ সালের ১৪৩০ টাকা থেকে ২০২৩-২৪ সালে ৪১২২ টাকা হয়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধি হার যোগ করলে স্পষ্ট হয়ে যাবে প্রকৃত ভোগ ব্যয় আদৌ বেড়েছে কি না। গ্রামের মানুষের ব্যবহারের জিনিসের দাম গত ১২ বছরে দুই থেকে চারগুণ বেড়েছে। এই সময়ে মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য টাকায় ৫৫ টাকা থেকে ৮৫ টাকা হয়ে গেছে। তেমনি দাবি করা হয়েছে গ্রাম-শহরে ভোগব্যয়ের ব্যবধান কমেছে। এটা গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশের উদাহরণ নয়। মনে রাখতে হবে গ্রামের কয়েক কোটি মানুষ শহরে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে যে উপার্জন করে সেটা গ্রামে পাঠানোর ফলেই তাদের খরচের সামর্থ্য কিছুটা বেড়েছে। গ্রামের মানুষ গ্রামীণ ভারতে রোজগার করে খরচের সামর্থ্য বাড়ায়নি। তেমনি দারিদ্র নির্ধারণের মাপকাঠি নিয়েও বিস্তর ধোঁয়াশা রয়েছে। এদেশে এখনও খাবারের ক্যালরি মেপে দারিদ্র মাপা হয়। ন্যূনতম প্রয়োজনীয় খাদ্য, বাসযোগ্য বাসস্থান, ন্যূনতম প্রয়োজনীয় বস্ত্র, ন্যূনতম শিক্ষার সামর্থ্য, ন্যূনতম চিকিৎসার সামর্থ্য ইত্যাদি দারিদ্র মাপায় গ্রাহ্য হয় না। তাই দারিদ্র দূরীকরণ নিয়ে বেশি বড়াই না করাই ভালো। মোদীর রিপোর্ট বলছে গ্রামের মানুষ প্রচুর খরচ করছেন। আর তাঁর বন্ধু কর্পোরেট মহল উদ্বেগ প্রকাশ করছে গ্রামে খরচ কমে যাওয়া নিয়ে। ভোগ্য পণ্য উৎপাদক সংস্থাগুলির বিক্রি কমে গেছে। অন্য অনেক সরকারি-বেসরকারি রিপোর্ট বলছে গ্রামের মানুষের আয় বাড়ছে না। অথচ জিনিসের দাম বেড়েই চলেছে।
Rural consumption
গোলক ধাঁধা
×
Comments :0