প্রতীম দে
উদ্বাস্তুদের তৈরি করা স্কুল। ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় এসে স্কুল, ক্লাব, খেলার মাঠ তৈরি করলো উদবাস্তুরা। কোথায় হলো সেই স্কুল। সুচেতানগর কলোনি। হালতু, যাদবপুরের বুকে গড়ে ওঠা ছোট্ট একটি কলোনী।
টুম্পা সরদার জানে না হালতু বিদ্যামন্দির অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় তৈরি ইতিহাস। সে শুধু জানে এটা একটা সরকারি স্কুল যেখানে তাঁর মেয়ে লেখা পড়া শেখে। কিন্তু সেই স্কুলটাই তো উঠে যাচ্ছে এবার।
টুম্পারা খবর দেখে না। খবর পড়ে না। লোক মুখে কিছু বিষয় জানতে পারে। স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে যখন তাকে স্কুল বন্ধ হওয়ার কথা বলা হয় তখন সে প্রথমে বিশ্বাস করেনি। মার্চের গরমে মিলনায়তন মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে কপালের পাশ দিয়ে ঘাম পড়তে শুরু করে তাঁর। কিছুটা বিরক্ত হয়েই টুম্পা সরদার বলেন, ‘‘কি বলছেন, ইস্কুল বন্ধ হয়ে যাবে? এটা তো সরকারি ইস্কুল। দুপুরে খাবার দেয়।’’ টুম্পারা ভাবে সরকারি স্কুল কখনও বন্ধ হতে পারে না। ঠিক যেমন সরকারি চাকরি করলে জীবনে কোন চিন্তা থাকে না কাজ চলে যাওয়ার।
সব কিছু শোনার পর কিছুক্ষন চুপ করে থেকে টুম্পা সরদার প্রশ্ন করেন, ‘‘আচ্ছা আর কোন কোন ইস্কুল বন্ধ হচ্ছে?’’
হালতু এফ পি স্কুলও বন্ধ হচ্ছে। শুনে আবার চুপ। তারপর, ‘‘তাহলে মেয়েকে পড়াব কোথায়? আর তো কোন সরকারি ইস্কুল রইলো না আমাদের এখানে।’’ এই চিন্তা শুধু টুম্পা সরদারের একার নয়। আরও অনেক অভিভাবকের।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর হালতুর বুকে তৈরি হয় একটা কলোনি। সুচেতানগর কলোনি। প্রথম থেকেই কলোনির মানুষজন ঠিক করে নিয়েছিল যে তারা কখনও সুচেতানগর ছেড়ে যাবে না। তখনও কোন নিশ্বর্ত দোলিল পাননি তারা।
১৯৫৫ সালে তৈরি হয় সুচেতানগর স্কুল। প্রাথমিক স্কুল। প্রথম দিকে জাম গাছ, কাঁঠাল গাছের তলায় ক্লাস হতো। তারপর খড়ের চাল দিয়ে তৈরি হয় ছোট একটি স্কুল। ধীরে ধীরে সেই স্কুল অষ্ঠম শ্রেণি পর্যন্ত অনুমোদন পায়। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার আসার পর উচ্চ-মাধ্যমিকের অনুমোদন পায় এই স্কুল। ওই একই সময় তৈরি হয় হালতু ফ্রি স্কুল। যা পরে নাম হয় হালতু হাই স্কুল।
উদ্বাস্তু এলাকা হালতু। উদবাস্তুদের চেষ্ঠায় তৈরি হওয়া দুটো স্কুল বন্ধ হতে বসেছে। দুটি স্কুলের পরিচালন সমিতির মাথাতেই শাসক দলের স্থানীয় নেতা এবং জনপ্রতিনিধি। ২০১১ সালের আগে স্কুলের পরিচালন সমিতিতে স্কুলের প্রাক্তনীরা থাকতেন। এলাকার বিশিষ্ট মানুষজন থাকতেন। অভিভাবকরা থাকতেন। কিন্তু এখন সরকারের নীতি অনুযায়ী কাউন্সিলর মনোনীত লোকজন স্কুল পরিচালন সমিতি চালায়।
বর্তমানে সুচেতানগর স্কুলের প্রাথমিক বিভাগে ছাত্রী সংখ্যা ১৩। শিক্ষিকা তিন জন। ৩০ জনের কম পড়ুয়া সংখ্যা হওয়ায় বন্ধ হচ্ছে স্কুল। হাই স্কুলে পড়ুয়া সংখ্যা ৩৩। শিক্ষিকা ১৯ জন। ৩০ এর বেশি বলে তা বন্ধ হচ্ছে না।
স্কুল বন্ধ হওয়াকে কেন্দ্র করে এলাকার মানুষের মধ্যেও একটা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। সঞ্জীব ঘোষ রায়। প্রথম জীবনে এই স্কুলে পড়েছেন। তখনও বালিকা বিদ্যালয় হয়নি। তিনি বলেন, ‘‘এলাকার মানুষদের নিয়ে আগে যখন স্কুল পরিচালন সমিতি ছিল তখন স্কুলের ভালো মন্দ সঠিক ভাবে বিচার করা হতো। এলাকার ছেলে মেয়েরা যাতে স্কুল ভর্তি হয় তার জন্য একটা চেষ্টা ছিল। শিক্ষক শিক্ষিকারা না এলে পাড়ার লোকেরা অনেক সময় ক্লাস নিতেন। কিন্তু এখন সেই আন্তরিকতা কোথায়? সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর কাউন্সিলরের লোকজন পরিচালন সমিতির মাথায় বসেছে।’’
২০১১ সালের আগে স্কুলে ছাত্রী সংখ্যা বাড়ার কারণে নতুন ঘর তৈরি করা হয় প্রাথমিক বিভাগের জন্য। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যাদবপুরের বিধায়ক থাকাকালিন সেই টাকা বরাদ্দ হয়। কাজও শুরু হয়।
১৯৭৭ সালে রাজ্যে প্রাথমিক স্কুল ছিল ৪০,৫৩৮ টি। বামফ্রন্ট সরকারের সময় তা বেড়ে হয় ৭৪,৭১৭। ২০২৩ সালে সেই সংখ্যা কমে হয়েছে ৬০,৮৫৪। গত ১২ বছরে ৭০১৮ টি প্রাইমারি স্কুল বন্ধ হয়েছে। ৩০৮৪ হাই স্কুল মাত্র তিন বছরে বন্ধ হয়েছে।
হাই কোর্টে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে জমা দেওয়া তালিকা অনুযায়ী ৮,২০৭টি সরকারি স্কুল বন্ধ হতে চলেছে। তার মধ্যে ১,৩৬২টি উচ্চ- প্রাথমিক স্কুল। ৬,৮৪৫ টি প্রাথমিক স্কুল।
কাকদ্বীপ, সাগর, নামখানা নিয়ে কাকদ্বীপ সাব ডিভিশন। ওই সব ডিভিশনের ৫০ এর বেশি স্কুল বন্ধ হতে চলেছে। কারা পড়ে এই স্কুল গুলোতে? বেশিরভাগ জেলে পরিবারের ছেলে মেয়েরা। জেলে পরিবারে ছেলেমেয়েরা যাতে পড়াশুনা করতে পারে তার জন্য বারবার আন্দোলন করেছে এসএফআই। কখনো সরকার নির্ধারিত ফি বা কখনো বিকল্প ক্লাসরুমের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া অংশের ছেলে মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তারা। এই পরিস্থিতিতে ফুল যখন উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তখন পড়াশোনার আঙিনায় আসা এই প্রান্তিক অংশের পড়ুয়াদের এবং তাদের পরিবারের মনে তৈরি হয়েছে নতুন আশঙ্কা। কোথায় গিয়ে তারা লেখা পড়া করবে? আর কি স্কুলে যাওয়া হবে না তাদের?
কেন্দ্রের মোদী সরকার নয়া শিক্ষা নীতির মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রকে বেসরকারিকরণ করে দিতে চাইছে। সরকারি স্কুল তারা তুলে দিতে চাইছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে কমছে বরাদ্দ। ডিকিটাল এডুকেশনের নাম করে শিক্ষার বাইরে বার করে দেওয়া হচ্ছে প্রান্তিক অংশের ছেলে মেয়েদের। মুখে জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০’র বিরোধিতা করলেও ঘুর পথে রাজ্যে নয়া শিক্ষা নীতি চালু করা হচ্ছে। সংখ্যার অজুহাত দিয়ে ৮০০০ স্কুল রাজ্যের মানচিত্র থেকে তুলে দেওয়া হচ্ছে। নিজেদের জন দরদী বলে দাবি করে বর্তমান সরকার। কিন্তু কেন সরকার কোন চেষ্টা করছে না লকডাউনে ড্রপ আউটের আওতায় পড়া ছেলে মেয়েদের স্কুলে ফেরানোর? কেনই বা সরকার কয়েকটা স্কুলকে মার্জ করে একটা ছাতার তলায় আনছে না?
শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতিতে ডুবে রয়েছে সরকার। স্কুল তুলে দিলে নিয়োগের সুযোগ কমবে। তাহলে সরকার কি চাইছে ‘শিক্ষিত বেকার’ বারতে থাকুক রাজ্যে?
Comments :0