Editorial

প্রতারণার সংস্কৃতি দুই শাসকেরই

সম্পাদকীয় বিভাগ


প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘বেটি বাঁচাও’ স্লোগান দিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির দল ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’ বলে নির্বাচনী প্রচার করেছিল। কিন্তু স্লোগানগুলি এখন নিছক প্রতারণামূলক এবং বিদ্রুপাত্মক পরিচয়ে স্পষ্ট হচ্ছে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ভারতে এখন প্রতিদিন গড়ে ৮৬ জনেরও বেশি মহিলা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। প্রতি ঘণ্টায় মহিলাদের বিরুদ্ধে অন্তত ৪৯টি অপরাধের ঘটনার খবর পাওয়া যাচ্ছে। অধিকাংশ ঘটনা ঘটছে বিজেপি-শাসিত উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান ও বিহারে। আর তৃণমূল-শাসিত পশ্চিমবঙ্গে প্রতিদিন মহিলা ও নাবালিকাদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অপরাধগুলি তো মানুষকে শিউড়ে দিচ্ছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই অভিযুক্তরা শাসক দলের সমর্থক বা কর্মী হলেই সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার তাদের সুরক্ষা দিতে নেমে পড়েছে। এই বিষয়ে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির সঙ্গে তৃণমূল শাসিত পশ্চিমবঙ্গের প্রভেদ করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। দুষ্টের পালন এবং প্রতিবাদীদের দমনই শাসকের সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। 
পশ্চিমবঙ্গে গত বারো-তেরো বছর ধরে একের পর এক ধর্ষণ ও ধর্ষণ করে খুনের মত মারাত্মক অপরাধে অভিযুক্তদের রক্ষা করতে পুলিশ এবং প্রশাসনকে নির্লজ্জের মতো ব্যবহার করা হয়েছে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নিজে একজন মহিলা হয়েও সামন্ততান্ত্রিক পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব দেখিয়ে কখনো নারী নির্যাতনের ঘটনাকে ছোট ঘটনা বলেছেন, কখনো নির্যাতিতাদেরই দোষারোপ করেছেন। অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারাই সমাজে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, রাজ্যের প্রায় সমস্ত প্রতিষ্ঠানে তাদের দিয়েই থ্রেট কালচার বা ভয়ের সংস্কৃতি কায়েম করেছ তৃণমূল। বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতেও এমন ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। উত্তর প্রদেশে এক নাবালিকাকে ধর্ষণে অভিযুক্ত বিজেপি বিধায়ক গ্রেপ্তার হয়েছে। সম্প্রতি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণে অভিযুক্ত তিন জনকে গ্রেপ্তারের কয়েক মাসের মধ্যেই জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তিন জনই বিজেপি’র মিডিয়া সেলের নেতা। পুলিশ প্রথমে তাদের গ্রেপ্তার করেনি। ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাপক বিক্ষোভের চাপে পুলিশ ওই অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়। অভিযুক্তদের শুধু জামিনে ছেড়ে দেওয়াই হয়নি, প্রতিবাদী ছাত্র-ছাত্রীদের উলটে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে, বহিষ্কারের প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে। এর আগে বিলকিস বানোর ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের বারবার প্যারোলে ছেড়ে দিয়েছে গুজরাট সরকার ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। এমনকী এই দুই সরকার মিলে তাদের সাজা মকুব করে ছেড়েও দিয়েছিল। অপরাধীদের মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দিয়েছিল বিজেপি। 
আরএসএস’র মতাদর্শে ভিন্নধর্মী, দলিত এবং মহিলাদের যে হীন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয় তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বিজেপি পরিচালিত সরকারের প্রশাসনিক আচরণেও। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের দলদাসে পরিণত প্রশাসনও রাতে এবং কর্মক্ষেত্রের সব পরিসরে মহিলাদের সাবলীল বিচরণের অধিকারকে অস্বীকার করে তাঁদের ঘরে কোণঠাসা করতে চাইছে। এর পিছনে বিজেপি’র যেমন মনুবাদী আদর্শ কাজ করছে, তৃণমূলের তেমনই দুষ্কৃতীরাজ কায়েম করে অবাধ দুর্নীতিতন্ত্র চালানোর স্পৃহা কাজ করছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সংবিধান অনুসারে জনগণের অধিকার রক্ষার বদলে পুলিশ ও প্রশাসনের আধিকারিকরা, তদন্ত করে অপরাধীদের শাস্তি বিধানের দায়িত্বপ্রাপ্তরা যখন এই শাসকদের হীন পন্থার শরিক হয়ে ওঠে তখন প্রতিকারের উপায় কী? এখানেই আর জি করের ঘটনা ঘিরে প্রতিবাদের প্রাসঙ্গিকতা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সারা দেশে। সমাজের সব অংশের মানুষের প্রতিবাদে শামিল হওয়া, ন্যায়বিচারের দাবিতে নাগরিক সমাজের সাহসের সঙ্গে মুখর হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। শুধু মাত্র সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্বই নয়, প্রশাসনিক কাঠামোর দায়িত্বপ্রাপ্তরাও যদি প্রতিবাদীদের এই বার্তা বুঝতে না পারেন তাহলে জনগণের তীব্রতর ক্ষোভের সামনেই পড়তে হবে তাদের সবাইকে। ‘বেটি বাঁচাও’ স্লোগানে কিংবা ‘বাংলার নিজের মেয়ে’ সাজার প্রতারণা অনেক হয়েছে। মহিলাদের সুরক্ষা, সমানাধিকার রক্ষায় সংবিধানের নির্দেশ অমান্য করে শাসকদলের অনুগত অপরাধীদের আড়ালে নামলে প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্তরাও কি রেহাই পাবেন!

Comments :0

Login to leave a comment