‘ভারতবর্ষ ধর্মনিরপেক্ষ দেশ’। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানের মর্মবস্তু’। ‘ধর্মনিরপেক্ষতার অপরিহার্য অর্থ হলো বেঁচে থাকো ও বাঁচতে দাও’। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা কোনও অভারতীয় ধারণা নয়’। সম্প্রতি এমন বেশ কয়েকটি মন্তব্য করেছেন ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি বিভিন্ন মামলার শুনানির সময়ে। এটাই দেশের সংবিধানের সঠিক স্বাভাবিক ব্যাখ্যা।
২০১৯ সালে মুম্বাই হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত বিচারপতি কেটি দেশাই স্মারক বক্তৃতায় বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেছিলেন, “যখন আমরা একজন কার্টুনিস্টকে রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে জেলে পাঠাই, বা যখন জামিনের পরিবর্তে একজন ব্লগারকে জেলে পাঠানো হয়, কোনও ধর্মীয় বিষয় নিয়ে সমালোচনা করার জন্য, নিজস্ব খাদ্যাভাসের জন্য একজন ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়, তখন আসলে সংবিধানকেই হত্যা করা হয়। আমরা যখন ধর্ম ও বর্ণের কারণে মানুষের ভালোবাসার শক্তিকে অস্বীকার করি, তখন সংবিধানই কাঁদতে হয়।”এটাই আমাদের দেশের সংবিধানের মূল ভাবনা, যার ভিত্তিতে বিচার হওয়া উচিত। ভারতের প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা নিয়োগের সময় শপথ নেন, ‘ভারতের সংবিধানের প্রতি সত্যিকারের বিশ্বাস এবং আনুগত্য বহন করবেন এবং যথাযথ ও বিশ্বস্তভাবে কাজ করবেন’। এই শপথও তাঁরা নেন যে, ভয় বা অনুগ্রহ, স্নেহ বা অনিচ্ছা ছাড়াই তাঁদের দায়িত্ব পালন করবেন এবং সংবিধান ও আইনকেই সবার উর্ধ্বে রাখবেন।
ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ নাস্তিকতা নয়। সবার নিজ নিজ ধর্ম থাকবে, বিশ্বাস থাকবে, তা পালন করবেন, কিন্তু বিচারকের আসনে বসে নিজ ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রাদান করবেন না— এটাই ভারতবর্ষের বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন, সরকারে যারাই আছেন, তাঁরা সবাই মেনে চলবেন— সংবিধানের নির্দেশিকাও তাই। কিন্তু প্রধান বিচারপতি যদি বলেন, রাম মন্দির নিয়ে রায়দানের সময় তিনি সংবিধান বা আইনের ওপর বিশ্বাস বা ভরসা না করে, ঈশ্বরে বিশ্বাস ভরসা রেখেছিলেন, তাহলে সে রায়দানে কি নিরপেক্ষ বিচার প্রতিফলিত হতে পারে!
ভারতের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় গত রবিবার ২০ অক্টোবর, ২০২৪ এ বলেছেন যে, ‘ অনেক সময় কোনও মামলার কোনও সমাধান মেলে না। তিন মাস ধরে বাবরি মসজিদ এবং অযোধ্যা মামলা ছিল আমার হাতে। আমি ঈশ্বরের সামনে বসেছিলাম। তাঁকে জানিয়েছিলাম আমায় একটা রাস্তা দেখাতে।' শ্রোতাদের প্রতি তাঁর আরও বক্তব্য ছিল, ‘আমাকে বিশ্বাস করুন, যদি আপনার বিশ্বাস থাকে ঈশ্বরে, সর্বদা একটি উপায় খুঁজে পাবেন।’ প্রসঙ্গত, রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিবাদ মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বে একটি বেঞ্চে শুনানি হয়, যেখানে বিচারপতি চন্দ্রচূড়, এস এ বোবদে, অশোক ভূষণ এবং এস এ নাজির ছিলেন অন্যতম সদস্য। এই বছর জুলাই মাসে তিনি নবনির্মিত অযোধ্যার রাম মন্দির দর্শন করতে গিয়েছিলেন। রামলালার কাছে প্রার্থনা করতেও দেখা যায় তাঁকে। বিচারপতিদের ধর্মীয় বিশ্বাস থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। যে যার ধর্ম মত অনুযায়ী নিজস্ব উপাসনালয়ে যেতেই পারেন। কিন্তু যে কোনও রায়দান যদি সংবিধান বা আইনের ভিত্তিতে না হয়ে, ঈশ্বর বিশ্বাসের ভিত্তিতে হয়, তখন ন্যায়ালয়ের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। যতক্ষণ কেউ সাংবিধানিক পদে থাকেন ততক্ষণ তাঁর চলার পথের একমাত্র ভিত্তি হতে হয় দেশের সংবিধান এবং সেখানে উল্লিখিত আইনসমূহকেই। না হলে, রায়দানে ন্যায়বিচার প্রতিফলিত হয় না। একইসাথে বিচার ব্যবস্থা, সরকার, সংসদ— এগুলি ক্ষমতার পৃথকীকরণ তত্ত্ব অনুযায়ী বিভাজিত। বিচার ব্যবস্থা যদি সরকারের সাথে মাখামাখি করে চলে, তাহলেও তার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এর আগেও দেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিজ বাসভবনে ব্যক্তিগত ধর্মাচরণের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে ক্ষমতার বিভাজন নীতিকে প্রশ্নের মুখে ঠেলেছিলেন প্রধান বিচারপতি, যা সমালোচনার মুখে পড়েছিল। দেশের সংবিধানকে পালটে সংবিধানের মর্মবস্তু ধর্মনিরপেক্ষতাকেই বিসর্জন দিতে চাইছে আরএসএস-বিজেপি এবং তা নিয়ে এমনকি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থও তারা হয়েছে। সে সময় প্রধান বিচারপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত স্তরে এহেন মাখামাখি অথবা অযোধ্যা-বাবরি মসজিদ বিবাদের বিতর্কিত রায়দান নিয়ে প্রধান বিচারপতির এই মন্তব্য নিঃসন্দেহে দেশের মানুষকে গভীর উদ্বেগের দিকেই ঠেলে দেয়।
Comments :0