Constitution

সংবিধান যখন হাতিয়ার হয়ে উঠছে

সম্পাদকীয় বিভাগ

সৌভিক ঘোষ
ধারণা সম্পর্কে আমরা যতটা মনযোগী, ধারণ যোগ্যতা প্রসঙ্গে ততটাই বেখেয়ালি। পণ্ডিতদের আলোচনা থেকে দোকানে সহজ কথাবার্তার অবসরে যতবার ‘মূল্য’ আসে, তার উপলব্ধির উল্লেখ এই কারণেই থাকে না। দেশ পরিচালনায় ইদানীং যারা দু’-চারগাছা ভোট জুটিয়ে নিতে পেরেছেন তাদের একান্ত আনন্দের বিষয়ই হলো এই যে একমাত্র তারাই ভারতের অতীত গৌরব মাটি খুঁড়ে বের করেছেন— সুতরাং জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া থাকলেও যা, না থাকলেও নাকি তাই। এবং তাদের দাবি এই যে মাটির নিচ থেকে ছাইপাঁশ উদ্ধার হলো, এমন বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণই আমাদের ‘সেই’ চিরায়ত অবস্তু দর্শনচেতনার চূড়ান্ত নিদর্শন। 
এহেন উপলব্ধি কীভাবে জনসাধারণের ধারণায় আসে, তাই নিয়ে অনেকেরই ভাবনার শেষ নেই। কেউ বলছেন এ যেন এক অনন্ত প্রহেলিকা যার শিকড় খুঁজতে হবে দেশের বেশির ভাগের মনে চেপে বসে থাকা চাষাড়ে যাপনে। কেউ আবার এমন মনোবৃত্তির আড়ালে ইতালি-জার্মানির যুদ্ধবাজ নায়কদের অবশেষকেই চিহ্নিত করছেন। হাসি পায়, উৎখনন প্রবৃত্তির উৎস হাতড়াতে সবচেয়ে বেশি বিদেশি ইতিহাসের পাতা ওলটাচ্ছেন তারাই পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ গোছের শব্দে যাদের বিবমিষা সবচাইতে বেশি। আসলে এও আরেক সুবিধাবাদ, আমাদের ভালো যা কিছু সবই মাটির তলায় চাপা পড়ে রয়েছে আর উপরে যা কিছু মন্দ সবকিছুর জন্য দায়ী বহিরাগতরা। এই ভাবনাই নয়া ফ্যাসিবাদের বীজ। 
পাখি ডিমে তা দিলে শিশুপ্রাণ ডানা মেলে ঠিকই, কিন্তু ডিমের মতো দেখতে একই ওজনের পাথরে সমুদ্রের ধারে রামের আশায় গালে হাত দিয়ে থাকা সম্পাতির সমান ধৈর্য নিয়ে চেপে বসলেও কিছু হয় না। এটুকুই বস্তুর ধর্ম সম্পর্কে সার কথা। অতএব বুঝতে হয় চারিদিকে যে গন্ডগোল— বাইরে থেকে উসকানি থাকুক আর নাই থাকুক, ভিতরের আগুনটুকু ছিলই। 
ঐ আগুন একসময় পায়ের পাতা থেকে সারা গা পোড়াতে পোড়াতে ক্রমশ গলা অবধি উঠে এসেছিল, সেই পোড়া দেহের বিনিময়েই তো আমাদের স্বাধীনতা। জ্বালা কমেনি, উপরের কালো চামড়াটুকু যতবার কিছুটা শুকিয়েছে— শিশুর মতো কৌতূহল নিয়ে খোসা ছাড়াতে গিয়ে আমরা বুঝেছি তলার ত্বক এখনও কাঁচাই রয়ে গেছে। এমনই দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের মেজাজকে এক জায়গায় নিয়ে এসেছিল যে কেতাব- তাকেই পালটে দিতে নতুন ফিকির শুরু হয়েছে। 
কখনো বলা হচ্ছে এক দেশ-এক আইন। ভাবটা কিছু এমন, পায়ের জোরে শরীরটা চলে বলে গোটা দেহজুড়ে শুধুই পা থাকবে কিংবা অভিশপ্ত ইন্দ্রের মতোই আমাদের সারা গায়ে চোখ ওঠা উচিত— কেননা ঐ দিয়েই তো দেখি। এই যে অযুক্তি (আনরিজন)- একে মোকাবিলা করতে শুধু কতিপয়ের চেতনায় গণতন্ত্রের উচ্চতম ধারণা থাকাই যথেষ্ট হবে না, গণতান্ত্রিক অধিকারের ধারণাটুকু এগিয়ে নিয়ে চলার, আরও প্রসারিত করার যোগ্যতা যে শাসকের নেই তাকে সিংহাসন থেকে টেনে নামাতে হবে। অর্থাৎ সব জেনে চুপ করে বসে থাকা চলবে না, আসনে বসিয়েছেন যারা— টেনে নামানোর হিম্মৎ ও অধিকারও যে তাদেরই আছে এই কথাটাই ঘুরে ফিরে বলতে হবে। আজকের ভারতে বিরোধী রাজনীতি মানে সেটাই। বাকি সব স্রেফ ভান-দ্বিচারি-ভণ্ডামি। 
মঙ্গল গ্রহে অনুসন্ধানযন্ত্র ক্ষেপণে সাফল্যের উদ্‌যাপন করা দেশে এমন অযুক্তি ঠাঁই পেল কী করে সেই নিয়ে বিতর্ক উঠতে পারে। চাষাড়ে দেশ শুধু যে আমরাই ছিলাম এমন তো নয়— আরও দুটি বিরাট দেশও যে তাই ছিল। তারা তো বিপ্লব সমাধা করল, তবে আমাদের এমন দশা কেন? এর উত্তর রয়েছে দাড়িওয়ালা দার্শনিকের কলমেই— ইংরেজরা এদেশে নিজেদের ক্ষমতা কায়েম করতে প্রাচীন, বহমান যা কিছু ছিল সবই ধ্বংস করেছিল, কিন্তু ভাঙার পরে গড়ে তোলার কাজটায় বিরাট ফাঁকি রেখে দিয়ে ব্রিটিশ অসভ্যতা নিজেদের মর্যাদা বজায় রাখে। পুরানো সবই নষ্ট হয়ে নতুন কিছু হাতে না এলে যা হয় তাই হয়েছে। এই জন্যই স্বাধীনতার ইতিহাসকে পর্যালোচনা করতে বসে যারা আমাদের সংগ্রামকে শুধুই ব্যবসা করার স্বাধীনতায় পর্যবসিত করেন তারা হয় মূর্খ না হয় আস্ত শয়তান। ব্রিটিশ রাজ নিজের সুবিধা করতেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছিল। নিজেদের সামাজিক কর্তৃত্বে বসিয়ে রেখে বিরাট সংখ্যক মানুষকে জাতের অজুহাতে বেগার না হলে অল্প মূল্যে খাটিয়ে নেয় যারা সেই সিস্টেম ইংরেজ ইচ্ছা করেই ভাঙেনি। আপসরফা করে নিয়েছিল। পুঁজির সাথে, মুনাফার সাথে ধর্মান্ধ-সাম্প্রদায়িক শক্তির আঁতাত তাই নতুন কিছু না। যেকোনও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তেরই কিছু অপচিতি প্রভাব থাকে— সেভাবেই এদেশে গড়ে ওঠে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত একটি প্রজন্ম। এরা উপলব্ধি করলেন ব্রিটিশ শাসন আসলে জোঁকের মতো- নিজেদের ভদ্রস্থ, সভ্য ঠাঁট ধরে রাখতে আমাদের রক্ত জল করে দিচ্ছে। এদেরই হাত ধরে বাংলায় রেনেসাঁর শুরু। যদিও সেই নবজাগরণ সারা দেশে সমানভাবে হয়নি। একে অস্বীকার করতে চাওয়া হয় কেন? অর্থশাস্ত্রের নিয়ম মেনে হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে মুনাফা লুটের অঙ্কে আজকের ভারতে অসাম্যের খতিয়ান সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে লুটের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, এমনকি ছাপিয়েও যেতে চলেছে। ইংরেজ প্রভুর ছেড়ে যাওয়া আসনে পাহাড়প্রমাণ সম্পত্তির মালিক ব্যবসাদার কীভাবে চড়ে বসল সেই ইতিহাসকে আড়াল রাখাই আজকের ভারতে অযুক্তির গোড়া। যেনতেন প্রকারেণ ইতিহাস গুলিয়ে দিতে আজকের শাসকের ব্যাগ্র মনোভাবও সেই জন্যই। এই শক্তি আটকে যাচ্ছে, বাধা পাচ্ছে একটাই কারণে। সেই বাধার নাম আমাদের দেশের সংবিধান।
আঘাত আসছে নানা কায়দায়। স্বাধীনতার জোরেই আমাদের দেশে জনশিক্ষা অন্তত কিছুদুর হলেও এগিয়েছে, শিক্ষিত যারা তাদের কাজ চাইবার যুক্তি আছে, দাবিও আছে আবার কাজ না পাওয়ার যন্ত্রণার কারণে সংগঠিত প্রতিবাদও আছে। এদিকে আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির চাহিদা হলো লুটের অবাধ ক্ষেত্র- সুতরাং নয়া শ্রম কোডের ছত্রে ছত্রে দাসবৃত্তির বয়ান। বিশ্ববাজারে মন্দা স্পষ্ট- সুতরাং দেশীয় পুঁজির খেলার ময়দান বদলানো দরকার, তাই নয়া কৃষি আইন। নিজেদের অতীত সম্পর্কে সঠিক অর্থে গর্ববোধ মুনাফার সামনে মাথা ঝোঁকাতে চায় না, তাই ইতিহাস বদলে দিতে ফতোয়া, হুমকি— এমনকি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অবধি। এই কাজ যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে না পারলে পুঁজি অন্যত্র চলে গেলে সাম্প্রদায়িক শক্তির কোমর ভেঙে যাবে। সংবিধান স্বীকৃত অধিকারগুলি শুধু আদানি, আম্বানিদের নেই— এদেশের কৃষিজীবী, শ্রমজীবীদেরও আছে। সেইসব আপিলের জোরে শাসকের সময় নষ্ট হচ্ছে, কখনো আটকেও যাচ্ছে।
আমরা তো গর্ব করতেই পারি ঐ বইতে লেখা অধিকার, কর্তব্যের জোরেই প্রধানমন্ত্রীকে নয়া কৃষিআইন বাতিল করতে হয়েছে। ঐ জোরেই এখনও তাকে নির্বাচন করতে হচ্ছে— ভোটে জিততে, ক্ষমতা দখল করতে তাকে অনেক বেশি কায়দা করতে হচ্ছে। এসবই পুঁজির চোখে— কর্তৃত্বের অধিকারকে ন্যায্য বলে মেনে চলা সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধদের চোখে সময় নষ্ট, অর্থাৎ লোকসান। 
আরেকবার কথা উঠবে বদলে দিতে উদ্যতরা সফল হবেই এমন বিপদের সম্ভাবনা কতদূর? যার জোরে তারা সাফল্যের কাছাকাছি এসেছে সেই অস্ত্রেই তাদের শেষ যুদ্ধ জিততে হবে। সেই হাতিয়ার ভেদ-ফারাক প্রতিষ্ঠায় অযুক্তির প্রচার। এর বিপরীতে মানুষের হাতে ধরা থাকবে দুটি চিরায়ত সত্য।
এক— খাদ্যগ্রহণের অভ্যাস, ভাষা, চামড়ার রং কিংবা রুচি এসবই আসলে বাইরের খোলস। মানুষ যেখানেই থাকুক, যেভাবেই থাকুক সে শুরু থেকে শেষ অবধি মানুষই। প্রকৃতি বিজ্ঞানের প্রত্যেকটি আবিষ্কারে সেই কথাই বারে বারে প্রমাণিত।
দুই— দুনিয়ায় অপসংস্কৃতি বলে আসলে কিছুই নেই। সংস্কৃতি আসলে দুটি, যারা মাথায় বসে রয়েছে তাদের চেতনা বদলের কথাই ইতিহাস বইতে লেখা রয়েছে, সেটাই শাসকের সংস্কৃতি। আজকের দুনিয়ায় পুঁজির সংস্কৃতি। আরেকটি গাথা তাদের, যারা কোনোদিন শাসকের আসনে বসেননি। তাই তাদের চেতনায় আর যাই থাকুক শোষণের অনুভব নেই। একে সর্বহারা সংস্কৃতি বলা যায়, আবার আমাদের দেশের নির্দিষ্ট বিবেচনায় লোকায়ত বললেও খুব বেশি অশুদ্ধি হয় না। প্রলেতারিয়েতের রুচি, সংস্কৃতিকে মহান বলার কারণ সেটাই। 
ধারণা ও ধারণ যোগ্যতার প্রসঙ্গে লেখার শুরু হয়েছিল। ধারণা মানে কী? মানুষ কিভাবে বাঁচবে- ইতিহাসের যেকোনও পর্যায়ে এইটাই ধারণা। ধারণ যোগ্যতা কি? ঐ ঐতিহাসিক পর্যায়ে মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে যতটুকু ব্যবধান থাকে তারই ভিত্তিতে ক্ষমতাসীন শাসকের যোগ্যতা বিচার-বিবেচনা করতে হয়। মানুষের ইতিহাস মানুষই রচনা করেন- ঠিকই, কিন্তু সেই রচনার সবটুকু নিজেদের ইচ্ছামতো হয় না। চারপাশের বস্তুগত সত্য যতদূর এগিয়েছে তার চাইতে বেশি মানুষ ভাবতে পারে না, এগোতেও পারে না। ইতিহাস এমনই বস্তুনিষ্ঠ। মেধা, মনন ইত্যাদি প্রসঙ্গেও মনে রাখতে হয় যেকোনও মানুষের যাবতীয় কল্পনা তার নিজস্ব বস্তুগত অস্তিত্ব (চেতন বা অবচেতন)-কে অতিক্রম করতে পারে না- কল্পবিজ্ঞান লেখকরাও তেমন কিছু পারেন না। ‘আউট অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ কারোর স্বপ্নবিলাস হতেই পারে, আসলে কেউই সেই কাজ করতে পারে না।  
তাই মোদীরা যা কিছু করছেন সেইসবের সবটা যেমন নতুন না, তেমনই সবই আগে থেকে নির্ধারিত হয়ে রয়েছে এমনও না। তেমন হলে কৃষকরা ওকে রাস্তায় বসে আটকে দিতে পারতেন না। 
তাই শাসক আরেকবার ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে। আমরা বলেছি সংবিধান রক্ষায় সকলে একে অন্যের হাত ধরুন। আমাদেরই কারোর হাত কিছুটা ফর্সা, আবার কারোর হাত কালো- কেউ আবার বাদামি। কারোর হাতে ডমরু খচিত, কোথাও হয়ত আল্লাহের নিরানব্বইটি নামের কোনও একটি, নিজের পছন্দের মানুষটির নামও নিশ্চিত পাওয়া যাবে। কেউ কলম ধরে আঙুলের গাঁটে কড়া ফেলেছেন, কেউ লাঙ্গল- কেউ হয়ত কিই বোর্ড। ওরা ফেয়ারনেস ক্রিম বেচে সাদা হয়ে ওঠার লোভ দেখিয়ে চলবেই, আমরা হাজার হাজার কালো মাথার সারিতে চোখে জ্বালা ধরানো ব্যবধানের ধুলো ঢেকে দেব। এই যুদ্ধে ওদের হাতিয়ার ‘মূল্য’, আমাদের ‘মূল্যবোধ’। গোটা একটা দেশের সমস্ত জনসাধারণের সম্মিলিত মূল্যবোধ। আমাদের সংবিধান তারই মূর্তরূপ।

Comments :0

Login to leave a comment