পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে যা কখনো ঘটেনি তাই ঘটেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির পরিবারের বেলায়। পশ্চিমবঙ্গের বুকে সর্ববৃহৎ নিয়োগ দুর্নীতিতে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর পারিবারিক সংস্থার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেছে আদালত। লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস নামের এই সংস্থার মাথায় বসে আছেন মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জি এবং মুখ্যমন্ত্রীর দাদা বৌদি। অথচ কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি’র পক্ষ থেকে এখনও অবধি সংস্থার এই মালিকদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না। বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্য্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অর্থনৈতিক অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধীদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়া স্বাভাবিক তার দেখা না গেলে প্রশ্ন উঠবেই, এবং তার পিছনের রাজনৈতিক কারণগুলিও অনুমানের অযোগ্য নয়। কেন্দ্র এবং রাজ্যের শাসক দলের বোঝাপড়ায় যদি সিজারের পরিবার ছাড় পেয়ে যায় তাহলে আর যাই হোক, সেটাকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আদর্শ নিদর্শন বলা যায় না। ন্যায়বিচার তাহলে সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করবেন কী করে!
এরাজ্যের বুকে হাজার হাজার যোগ্য, মেধাবীদের বঞ্চিত করে বিপুল টাকার বিনিময়ে সরকারি চাকরি পাইয়ে দেওয়ার যে দুর্নীতি ঘটেছে, তাতে খোদ লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের বিরুদ্ধেই চার্জ গঠন রীতিমত তাৎপর্যপূর্ণ। নিয়োগ দুর্নীতিতে ২২টি সংস্থা সহ ৫৪জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন হয়েছে, তার মধ্যে লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জির ব্রেনচাইল্ড সংস্থা ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’। এর দু’টি অংশ, একটি হলো- ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড’। দ্বিতীয়টি হলো- ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ড ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস এলএলপি’। দু’টি সংস্থার ঠিকানাও একই- ব্লক পি, পি-৭৩৩, নিউ আলিপুর, কলকাতা-৭০০০৫৩। দু’টি সংস্থাতেই বর্তমানে ডিরেক্টর দু’জন- লতা ব্যানার্জি(অভিষেক ব্যানার্জির মা), অমিত ব্যানার্জি( অভিষেক ব্যানার্জির বাবা)। এই লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের আগের ঠিকানা ছিল খোদ মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের ঠিকানা অর্থাৎ ৩০/বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট। শুধু তাই নয় ২০১২ সালে কোম্পানির প্রথম ডিরেক্টর হিসাবে অভিষেক ব্যানার্জি, তাঁর মা লতা ব্যানার্জির নাম ছিল। অভিষেক ব্যানার্জি ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ হলেও গত লোকসভা নির্বাচনে তাঁর দাখিল করা হলফনামায় লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের কোনও প্রসঙ্গই উল্লেখ করেননি। একটি সংস্থার সিইও হয়েও সেটি হলফনামায় কেন চেপে গেছিলেন অভিষেক ব্যানার্জি সেটা যদি একটি প্রশ্ন হয়, তবে তার সম্ভাব্য উত্তর পাওয়া যেতে পারে ইডি’র দাখিল করা চার্জশিটে। তাতে দেখা যাচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রীর আপাদমস্তক পারিবারিক এই সংস্থাতেই ঢুকেছিল যোগ্য মেধাবীদের চাকরি তথা স্বপ্নকে বিক্রি করার দুর্নীতির টাকা। খাতায় কলমে চালানো এই কোম্পানির প্রকৃত ব্যবসায়িক কার্যকলাপের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য কোনও আয়ই নেই, বরং কালো টাকা এই কোম্পানির অ্যাকাউন্টে ঢুকিয়ে সাদা করার প্রক্রিয়া চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে চার্জশিটে। সংস্থার বেশ কিছু সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করাও হয়েছে।
অভিষেক ব্যানার্জিকে জেরার জন্য ইডি ডেকেছিল, কিন্তু সেখানেই কি তাদের দায়দায়িত্ব শেষ? কেন ইডি অভিষেক ব্যানার্জি এবং তার বাবা মায়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না? এর আগে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র যিনি কালীঘাটের কাকু নামেই সমধিক প্রচারিত তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে দেওয়া চার্জশিটেও অভিষেক ব্যানার্জির সংস্থার উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ তাঁর মাধ্যমেই লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে দুর্নীতির টাকা ঢুকেছে বলে ইডি’র অভিযোগ। এসবের পরেও যদি কেন্দ্র এবং রাজ্যের শাসক দলের রাজনৈতিক বোঝাপড়ার কারণে তদন্তকে কবরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেই কালীঘাটের কাকুর কথাই সত্য বলে প্রমাণিত হবে। এই কাকুর কন্ঠস্বরে যখন দাপুটে জোর ছিল তখনই তিনি বলেছিলেন, যে তাঁর ‘সাহেবকে কেউ ছুঁতে পারবে না’। না ছুঁয়ে এমন লোকদেখানো তদন্ত আসলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রতি একধরনের প্রতারণামূলক রাজনীতি।
Editorial
তদন্তের নামে প্রতারণা
×
Comments :0