রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু রাজ্যে পৌঁছানোর ২৪ ঘণ্টা আগে বীরভূমে এক আদিবাসী দম্পতিকে পিটিয়ে খুন করল দুষ্কৃতীরা। সেই খুনের পর গা ঢাকা দিয়েছেন তৃণমূলের এক পঞ্চায়েত সদস্য।
ঘটনা শনিবার সকালের। বীরভূমের আহমেদপুরের নোয়াপাড়ার গরিব ভাগচাষি পান্ডু হেমব্রম ও তাঁর স্ত্রী পার্বতী হেমব্রমকে বাড়ির সামনেই বাঁশ দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাতে খুন করা হয়। গোটা শরীর আঘাতে হয় ক্ষতবিক্ষত। গাঁয়ের মোড়ল তথা তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য সোম মুর্মুর কাছে খবর পেয়ে ছুটে আসে আক্রান্তদের ভাইপো। তাঁকে দিয়েই দেহ দুটিকে পাঠানো হয় বোলপুর হাসপাতালে।
সেই মিস্ত্রি হেমব্রমের কথায়, ‘‘মোড়লই ডেকে পাঠায় আমাকে। আমি গিয়ে দেখি কাকা-কাকির রক্তাক্ত দেহ গাড়িতে চাপানো। মোড়ল বলে হাসপাতাল নিয়ে যেতে। হাসপাতাল নিয়ে দেখি কাকি মারা গেছে আগেই। কিছুক্ষণ বাদে কাকাও মারা যায়। পুলিশ আসে। দুপুরে পোস্টমর্টেম হয়। তারপর সন্ধ্যায় দেহ দুটি নিয়ে গাঁয়ে ফিরে আসি। তখন গাঁয়ে থাকা রুবই বেসরা সহ অন্যান্যরা এবং পুলিশ তাড়াতাড়ি পাশের গ্রাম বেনেডাঙায় নিয়ে গিয়ে দেহগুলি দাহ করতে বলে।’’
ঘটনাক্রমে স্পষ্ট, গ্রামের তৃণমূল সদস্য, তাঁর অনুগামী প্রাক্তন মোড়ল এবং পুলিশ চেয়েছিল নিহত আদিবাসী দম্পতির দেহ শেষকৃত্য দ্রুত সম্পন্ন করে নৃশংসভাবে পিটিয়ে খুনের জেরে এলাকায় উত্তেজনা গোড়াতেই দমিয়ে দিতে। কিন্তু সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে দেয় ঘটনার খবর পেয়ে আশপাশের গ্রাম থেকে জড়ো হওয়া শ’য়ে শ’য়ে মানুষের আপত্তি, ক্ষোভ।
শনিবার সন্ধ্যা থেকে রবিবার দুপুর পর্যন্ত প্রায় কুড়ি ঘণ্টা ধরে দেহ দুটি বেনেডাঙার শ্মশানেই রেখে দেন এলাকার মানুষ। তাঁরা পুলিশের উদ্দেশ্যে বলেন, আদিবাসী রীতিতে মোড়লের উপস্থিতিতেই শেষকৃত্য হয়। কিন্তু মোড়লই তো পলাতক। কেন তিনি পালালেন? কারা এই খুন করল? সবাইকে আগে ধরতে হবে। সাজা দিতে হবে।
দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর দোষীদের গ্রেপ্তারের নিশ্চিত আশ্বাসে রবিবার দুপুর দুটো নাগাদ সমাধিস্থ করা হয় দেহ দুটি। জেলা পুলিশের এক আধিকারিকের দাবি, ‘‘গ্রামে অবৈধভাবে মদ বিক্রির অভিযোগ ছিল মৃত দম্পতিদের বিরুদ্ধে। গ্রামের বাকিরা তাদের বারংবার বারণ করলেও তারা শোনেনি। সেই থেকেই বিবাদ। তার জেরেই এই ঘটনা। ধৃত রুবইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মিলেছে এমন তথ্য। বাকি অভিযুক্তদের খোঁজে তল্লাশি চলছে।’’
মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর বীরভূমেই আসার কথা। বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে তিনি আমন্ত্রিত। সোমবার রাষ্ট্রপতি কলকাতায় পৌঁছাবেন। তাঁর যাওয়ার কথা নেতাজী ভবনে, জোড়াসাঁকোয় ঠাকুরবাড়িতে। উপস্থিত থাকার কথা নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে, রাজ্য সরকার আয়োজিত সংবর্ধনা সভায়। তাঁর রাজ্য সফরের আগে বীরভূমে আদিবাসী দম্পতিকে খুনের ঘটনা তাড়াতাড়ি ধামাচাপা দিতে মরিয়া পুলিশ, এমন অভিযোগ অনেকেরই।
এদিন সকালের ঘটনার পর কিছু প্রশ্ন উঠেছে। প্রথমত, ‘ডাইন’ অপবাদে পিটিয়ে খুন, নাকি পেছনে রয়েছে গাঁয়ের মাতব্বরদের বশ্যতা না স্বীকার করার আক্রোশ? নোয়াপাড়ায় সাতসকালে নৃশংসভাবে পিটিয়ে এক আদিবাসী দম্পতিকে মেরে ফেলার কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা অনেক। দ্বিতীয়ত, ঘটনার সাক্ষী গাঁয়ের বর্তমান মোড়ল। যিনি আবার তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্যও। ঘটনার পর থেকেই কেন পলাতক দলবল নিয়ে? তৃতীয়ত, সকালে বেধড়ক মারের আঘাতে মৃত দম্পতির দুপুরে ময়না তদন্ত করে সন্ধ্যায় তড়িঘড়ি শেষকৃত্য করার জন্য কেন মরিয়া হয়ে ওঠে পুলিশ? চতুর্থত, পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে গ্রামের প্রাক্তন মোড়লকে। আশপাশের গাঁ থেকে জড়ো হওয়া মানুষের চাপে। গাঁয়ের বর্তমান মোড়লের অনুগামী প্রাক্তন মোড়লের প্রতি এত ক্ষোভ কেন এলাকার ?
ভাগে চাষ করেই কোনক্রমে দিনগুজরান ছিল হতদরিদ্র পার্বতী-পাণ্ডুর। দম্পতির তিন মেয়ে ও এক ছেলে। তিন মেয়ে বিবাহ সূত্রে থাকেন বাইরে। ছেলে পরিযায়ী শ্রমিক, থাকেন দিল্লিতে। বাবা-মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে রওনা হয়েছেন সেখান থেকে। অঝোরে কেঁদে চলেছেন দম্পতির মেয়ে বুদিন হেমব্রম। কাঁদতে কাঁদতেই জানিয়েছেন, ‘‘শনিবার খবর পেয়ে যখন হাসপাতালে যাই তখন দেখি বাবা-মা কেউই বেঁচে নেই। গোটা শরীরে রয়েছে আঘাতের চিহ্ন বাবা-মায়ের। পিটিয়েই খুন করে দেওয়া হয়েছে।’’
রুবই হাঁসদার স্ত্রী দিন কয়েক আগে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। সেই মৃত্যুর জন্য দম্পতিকে ডাইন আখ্যা দিয়ে তাদের উপর অত্যাচার শুরু করেছিল মোড়লের দলবল। সেই থেকেই হয়ত শনিবারের ঘটনা এতবড় আকার নিয়েছে। এমন কথা প্রচারিত হলেও দম্পতি সম্পর্কে ও নোয়াপাড়ার হাল হকিকৎ জানা এক যুবক স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘‘আসলে পাণ্ডুর সঙ্গে মোড়ল, প্রাক্তন মোড়লদের বনিবনা ছিল না। কারণ তাঁদের কথায় চলতে রাজি ছিল না পাণ্ডু। গাঁয়ে তো ওরাই শেষ কথা ছিল। অন্যান্যরা তা মেনে নিলেও পাণ্ডু ছিল অন্যরকম। গাঁয়ের মানুষের কাছে পাণ্ডুর নাম ছিল। যে কোনও বিপদে আপদে ছুটে আসত। হয়ত তা সহ্য হয় ওই সকল মাথাদের। তাই হয়ত তাকে জব্দ করতে গিয়ে এই বিপত্তি হয়েছে।’’
দম্পতি খুনের ঘটনায় এলাকায় ক্ষোভের পারদ চড়তেই নোয়াপাড়ার আদিবাসী মহল্লা কার্যত জনমানব শূন্য হয়ে গিয়েছে। গ্রামের প্রাক্তন মোড়ল রুবই গ্রেপ্তার হয়েছে। বর্তমান মোড়ল তথা তৃণমূল মেম্বার বেগতিক বুঝে গা ঢাকা দিয়েছে। ভয়ে অন্যান্যরাও সেই পথ ধরেছে।
রাজ্য আদিবাসী অধিকার মঞ্চের নেতা জটায় মুর্মু, পল্টু কোঁড়া ঘটনার তদন্ত এবং দোষীদের গ্রেপ্তার দাবি করেছেন।
Comments :0