সৈনিক শূর
১৯৭৩ সালের ২৮ মার্চ, কলকাতার কালো পিচের রাস্তাকে সাক্ষী রেখে ইতিহাস তৈরি করেছিল এ রাজ্যের যুব আন্দোলনের বীর সেনানীরা। তখন ডিওয়াইএফ, গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন। সংগঠনের রাজ্য কমিটি ডাক দিয়েছিল বেকারি বিরোধী দিবসের। কাজ চাই, কাজ দাও নাহলে বেকার ভাতা দাও স্লোগান দিয়ে সারা দেশের সামনে বেকারি বিরোধী দিবস পালনের মধ্যে দিয়ে যুব সমাজের মূল দাবিগুলিকে সামনে এনেছিল সেদিনকার লাখো যুবর মিছিল। জ্যোতি বসু, হরেকৃষ্ণ কোঙারদের উপস্থিতি যুবদের লড়াইকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছিল জনমানসে। পরবর্তীতে সারা দেশেই ২৮ মার্চ পালিত হয় বেকারি বিরোধী দিবস। ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে, তবুও সেদিনের দাবি আরও বহুগুণ বেশি মাত্রায় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। গত ৫০ বছরে দেশে বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ অবস্থায় পৌঁছেছে। মোদী সরকারের আমলে বেকারত্বের জ্বালায় তপ্ত হয়েছে যুবসমাজ আর তত ফুলে ফেঁপে উঠেছে আদানি -আম্বানির সম্পদ। আজ থেকে ৯০ বছর আগে ১৯৩৩ সালে সোভিয়েত বিপ্লবের ঠিক ১৬ বছরের মাথায় এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে তালা ঝুলিয়ে যোসেফ স্তালিন ঘোষণা করেছিলেন সোভিয়েতে আর একজনও বেকার নেই। এটাই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকল্প হিসাবে আমাদের কাছে উদাহরণ হয়ে আছে। অথচ আমাদের দেশে বর্তমান সময়ে আমরা দেখছি বেকার যুবদের যাতে কাজ দিতে সরকারের কোনও দায়িত্ব না থাকে সেই কারণে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ তুলে দিতে তৎপর মোদী-মমতারা। আগ্রাসী নয়া উদারবাদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে কর্মসংস্থানের উপর। এর মধ্যে আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে কোভিড ১৯-এর মতো মহামারী। এই সময়কালে অভূতপূর্বভাবে বেড়েছে বেকারি। যেহেতু সঙ্কটগ্রস্ত পুঁজিবাদ কোনও দীর্ঘস্থায়ী কর্মসংস্থানমুখী উন্নয়নের মডেল হাজির করতে অক্ষম তাই কর্মচ্যুতি এবং কাজের অস্থায়ীকরণই এই সময়ের মূল প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনা পরবর্তীতে আমাদের দেশে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে কাজ হারিয়েছেন প্রায় ২০ কোটি মানুষ।
শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার প্রায় ১০ শতাংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারা দেশের অর্থনীতি কর্মসংস্থানহীন বৃদ্ধির দিকে এগিয়েছে ক্রমাগত। কর্মসংস্থানের অভাবের সঙ্গে ছদ্ম বেকারত্ব গ্রাস করেছে যুব সমাজকে। দেশের সরকার স্থায়ী কাজকে আস্তে আস্তে বিলুপ্ত করতে চাইছে। তার ফলে গোটা দেশেই এবং আমাদের রাজ্যেও অস্থায়ী কাজের দিকে যেতে বাধ্য হচ্ছে যুব সমাজ। এমনকি সরকারি শূন্য পদেও স্থায়ী নিয়োগের পরিবর্তে অস্থায়ী ভিত্তিতে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করে কাজ চালানোর নীতি নিয়েছে শাসকেরা। আর্থিক কারণে যুব সমাজের বিপুল অংশ অস্থায়ী অনিয়মিত কাজের সাথে যুক্ত হচ্ছে। তাদেরকে দৃশ্যত কাজের সাথে যুক্ত মনে হলেও প্রকৃত অর্থে তারা আধা-বেকার। কাজের নিশ্চয়তা নেই, সঠিক মজুরি নেই, সামাজিক সুরক্ষা নেই, উপরন্ত কাজের সময়ও অনেক বেশি। এই অংশই প্রতিদিন বাড়তে থাকছে। শহর কলকাতাতেও প্রতিদিন গ্রাম থেকে এবং রাজ্যের বাইরে থেকে আসা শ্রমজীবী যুবর সংখ্যা বাড়ছে। পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার ৬০%-এর বেশি যুববয়সি। শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে ৯৩% অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মী, এই অংশের না থাকছে কোনও কাজের গ্যারান্টি, না থাকছে ন্যূনতম মজুরির নিশ্চয়তা। নয়া উদারবাদী আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে সবচেয়ে আক্রান্ত হচ্ছে গরিব প্রান্তিক অংশের যুবরাই। সরকারি ক্ষেত্রে শূন্যপদ বিলুপ্তকরণের সবথেকে বড় উদাহরণ রেল দপ্তর। দেশের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রেল দপ্তরে বর্তমানে প্রায় কয়েক লাখ শূন্যপদ পড়ে রয়েছে। অথচ ২০২২ সালে ঢালাও বেসরকারিকরণের নীতি নিয়ে ৮০ হাজার শূন্যপদ বিলোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেল। এরকম প্রতিটি সরকারি ক্ষেত্রে স্থায়ী নিয়োগের পরিবর্তে অস্থায়ী চুক্তিভিত্তিক কর্মী দিয়ে কাজ চালাচ্ছে দুই সরকারই। আমাদের রাজ্যেও সরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি প্রতিদিনই নতুন নতুন তথ্য সামনে আনছে যাতে উন্মোচিত হচ্ছে এই সরকারের মুখোশ। কেন্দ্রীয় সরকারি দপ্তরে প্রায় ৭ লক্ষ অনুমোদিত শূন্যপদ পূরণ করা হচ্ছে না উলটে ৫ বছরে পূরণ হয়নি এমন শূন্যপদ সরাসরি তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার আগে বলেছিলেন বছরে ২ কোটি বেকারের কর্মসংস্থান করবেন। নতুন কর্মসংস্থান তো দূর অস্ত উলটে এই সময় পর্বে কাজ হারিয়েছেন কয়েক কোটি মানুষ। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, শহরাঞ্চলে বসবাস করা ২৩% যুবক যুবতীর কোনও স্থায়ী কাজ নেই। বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে ২০২১ সালে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৬ কোটি। অথচ কাজে নিযুক্ত মানুষ কমতে কমতে মাত্র ৩৮ কোটিতে এসে ঠেকেছে। আরও তথ্য বলছে ২০১৩ সালে মহিলা শ্রমশক্তির মধ্যে কাজে নিযুক্ত ছিলেন ৩৬%। ২০২১ সালে এটা কমে দাঁড়ায় ৯.১৪%। সিএমআইই রিপোর্ট বলছে, ২০২০ সালে আমাদের দেশে মোট বেকারের মধ্যে যুব অংশের বেকারির হার বাড়তে বাড়তে ২৩.৭৫% এসে পৌঁছেছে। আর একই সাথে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিতে স্থায়ী কর্মীর পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমতে শুরু করেছে আর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অস্থায়ী এবং ঠিকা কর্মীর সংখ্যা। লাগামছাড়া হয়েছে ছাঁটাইয়ের পরিমাণ। ৪৪ টি শ্রম আইনকে ৪ টি শ্রম কোডে পরিণত করে বেসরকারি সংস্থায় আরও দমন পীড়ন চালাবার পথ প্রশস্ত করেছে শাসকশ্রেণি। বামপন্থী যুব আন্দোলনের পক্ষ থেকে মহামারী পর্বে রাজ্য এবং কেন্দ্র সরকারকে ছাঁটাই বন্ধ করতে কড়া আইন আনার জন্য দাবি জানানো হয়েছিল। সেই দাবি এখনও প্রাসঙ্গিক। দুই সরকারই ছাঁটাই বন্ধ কিংবা সামাজিক সুরক্ষার পরিবর্তে মালিকপক্ষের মুনাফার পথকেই উৎসাহিত করেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সহ বেঁচে থাকার জন্য সামগ্রীর মূল্য যেভাবে বাড়ছে তাতে ন্যূনতম ২৬ হাজার টাকা মজুরি না পেলে জীবন জীবিকা নির্বাহ করা অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের পক্ষে দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।
আমাদের রাজ্যেও কর্মসংস্থানের হাল হকিকত ভয়ঙ্কর অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে তৃণমূল সরকারের আমলে। সরকারি চাকরির পরীক্ষা থেকে পৌরসভায় নিয়োগের দুর্নীতিতে তৃণমূল নেতাদের পকেট ফুলে কলাগাছ হতে বাকি থাকেনি। দুর্নীতির অতল গভীরে রাজ্যকে তলিয়ে দেওয়ার ঘটনা সামনে আসছে রোজ। তোলাবাজি সিন্ডিকেট রাজ বেআইনি নির্মাণের সাথে লোভ লালসার মাধ্যমে যুবসমাজকে যুক্ত করে স্থায়ী কর্মসংস্থানের বুনিয়াদি অধিকারকে পিছনের দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছে সরকার। কলকাতা কর্পোরেশনে প্রায় ৩০ হাজার শূন্যপদ পড়ে রয়েছে। কলকাতা কর্পোরেশনের ১৪৪টি ওয়ার্ডে গড়ে ২০০ জনের বেশি স্থায়ী কাজের সুযোগ হতে পারে এই ৩০ হাজার শূন্যপদে স্থায়ী নিয়োগ হলে। বেকারি বিরোধী দিবসের মিছিল থেকেও তাই সমস্ত শূন্যপদে স্থায়ী নিয়োগের দাবি আরো জোরালো হবে। কলকাতা ও অন্যান্য শহরে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে একটা বড় অংশের যুব সমাজ অ্যাপ-বেসড ওয়ার্কার হিসাবে বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করে থাকেন। এই সমস্ত যুবদের না আছে ন্যূনতম মজুরির গ্যারান্টি, না আছে কোনোও সামাজিক সুরক্ষা। উলটে প্রতিদিন ছাঁটাইয়ের ভ্রুকুটি নিয়েই প্রাণান্তকর পরিশ্রম করতে হয় এই কর্মীদের। সরকারের পক্ষ থেকেও প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করা এই বিপুল অংশের যুবদের প্রতি বিন্দুমাত্র সহযোগিতা আমরা লক্ষ্য করি না। বেকারি বিরোধী দিবস থেকে শুরু করে বছরের বাকি ৩৬৪ দিনই এই তীব্রতর আক্রমণের মুখে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, ন্যায়সঙ্গত মজুরি সহ সামাজিক সুরক্ষা ও ছাঁটাই বন্ধের দাবিতে তীব্রতম প্রতিরোধ গড়ে তোলাই সময়ের ডাক। বিপুল অংশের বেকারদের বেকার ভাতা দেওয়ার পরিবর্তে মোদী মমতার সরকার কর্পোরেট দের ট্যাক্স ছাড় দিতে বেশি আগ্রহী হয়েছে। একদিকে দাঁড়িয়ে যখন সারা দেশে বিলিওনিয়ারের সংখ্যা বেড়ে ১০০ ছাড়িয়েছে তার উলটোদিকে বৈষম্যের মাত্রাও বেড়েছে বহুগুণ। ১০% কর্পোরেটের হাতে সারা দেশের প্রায় ৭০% কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এই বৈষম্যের অর্থনীতির বিরুদ্ধে বিকল্পের কথা বলতে ন্যূনতম ৬০০০ টাকা বেকারভাতার দাবি তোলা হয়েছে।
কাজকে সংবিধানে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি কিংবা সমাজতন্ত্রের আদর্শে যুবসমাজকে আন্দোলিত করার ঐতিহাসিক মহড়ায় বেকারি বিরোধী দিবস আমাদের কাছে ৩৬৫ দিন লড়াইয়ের রসদ জোগায়। আমরা স্বপ্ন দেখি একদিন আর আমাদের বেকারি বিরোধী দিবস পালনের প্রয়োজন পড়বে না, সব বেকারের হাতে কাজের গ্যারান্টি থাকবে এরকম একটা সমাজ ব্যবস্থার। সেই লড়াইয়ের স্বপ্নে অটল থেকেই বেকারি বিরোধী দিবসের ৫০ বছরে স্লোগান উঠছে, ‘দুর্নীতি রাজ নিপাত যাক, বেকার যুবরা কাজ পাক’।
Comments :0