Leather complex death

অভাবের সংসারেও ভয়ানক শোকের মধ্যেই প্রশ্ন, ‘চলবে কীভাবে?’

রাজ্য কলকাতা

 


গ্রামে খুবই অভাব, নেই কাজ। সংসার চালাতে যেতেই হয় এদিক ওদিক। এভাবেই কলকাতায় কাজের জন্য এসেছিলেন ওঁরা তিনজন। কিন্তু আর ওঁদের ফেরা হলো না পরিবারের কাছে। সুরক্ষাবিহীন ম্যানহোলে সাফাইয়ের কাজে নেমে মৃত্যু হলো তিনজনের। ওঁদের মধ্যে ফরজেম শেখ (৬০) ও হাসিবুর রহমান (২৬)-এর বাড়ি লালগোলায়। আরেকজন সুমন সর্দার (৩২)-এর বাড়ি বসিরহাটে। স্বজন হারানোর হাহাকার আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভয়াবহ চিন্তা ঘিরে ধরেছে তাঁদের পরিবারকে। 
অভাবের সংসার ছিল ফরজেম শেখের। টালির ছাউনির নিচে ইটের বাড়িতে চার মেয়ে, দুই ছেলে নিয়ে তাঁদের পরিবার।  রবিবার সকালেও পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছিল। জানিয়েছিলেন- ‘কাজে বেরোচ্ছি’। ফরজেম শেখের বড় ছেলে জাহাঙ্গীর আলম জানান, ‘‘কোনও খবর নেই দেখে ঠিকাদারকে ফোন করেছি। তাঁরাও কিছু বলতে পারছিলেন না। ওখানকার শ্রমিকরাও কিছু জানাতে পারেননি। আমরা ফোন করে পরিবারের অন্য লোকজন পাঠাই। তাঁরা খোজ নিয়ে জানান, বাবা আর নেই। কখনও বেলঘরিয়া, কখনও দমদমে কাজ করতেন। চাষের কাজে অনেক খরচ, তাই ওই মজুরের কাজ করতেন। এখন তো বাবার জীবনটাই চলে গেল।’- আক্ষেপ ছেলের। 
লালগোলারই বাসিন্দা মাত্র ২৬ বছর বয়সি হাসিবুল রহমানের বাড়ি টিকরপাড়া এলাকায়। মর্মান্তিকভাবে মৃত্যু হয়েছে তাঁরও। যুবকের মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন পরিবারের লোকজন। স্ত্রী বিলকিস খাতুন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তিনি জানালেন, ‘রাতে কথা হয়েছিল স্বামীর সঙ্গে’। বুক ফাটা আর্তনাদে ভেঙে পড়ছেন তিনি। কথা বলার মতো অবস্থায় নেই হাসিবুরের মা তাজমিরা বিবি। ছেলের কথা বললেই শুধ কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। হাসিবুরের রয়েছে এক মেয়ে। ‘ওকে কীভাবে বড় করবো’ - বারবার একথাই জিজ্ঞেস করছেন স্ত্রী বিলকিস। 
ঘটনার খবর পেয়ে লালাগোলায়ওই দুই শ্রমিকের বাড়ি যান সিপিআই(এম) কর্মীরা। মৃত শ্রমিকদের পরিবারকে নিয়ে লালগোলা থানায় যান আইড়মারি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান আওয়াল হোসেন। ছিলেন পঞ্চায়েত সদস্য রওসন জামান। পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন লালগোলা পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ ইসমাইল হক, সিআইটিইউ’র পরিযায়ী শ্রমিক ইউনিয়নের জেলা সম্পাদক  নেতা কামাল হোসেন। মৃত শ্রমিকদের পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছে ওয়েস্ট বেঙ্গল মাইগ্রান্ট ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন। কামাল হোসেন বলেন, নিয়ম মেনে কাজ হচ্ছে না। কিন্তু ন্যূনতম সুরক্ষা সরঞ্জামও পান না  শ্রমিকরা। সরকারি গাফিলতির শিকার দুই শ্রমিক। পরিবারের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।
বানতলার লেদার কমপ্লেক্সে ম্যানহোল পরিষ্কার করতে গিয়ে কেএমডিএ’র যে অস্থায়ী তিন শ্রমিকের মৃত্যু হয় তাঁর মধ্যে রয়েছেন সুমন সর্দার (৩২)। উত্তর ২৪পরগনার বসিরহাট মহকুমার ন্যাজাট ৫নং পাড়ার বাসিন্দা তিনি। আদিবাসী নিবিড় সেই পাড়ায় এখন শুধুই হাহাকার, একরত্তি মেয়েদের বুকফাটা কান্না, অন্ধ বাবা আর মায়েরর আর্ত চিৎকার- কে দেখবে আমাদের। কে দুবেলা দুমুঠো ভাত মুখে তুলে দেবে। বড় মেয়ে ১২ বছরের ঈশানি সর্দার, ৯ বছরের ঈশিতা সর্দার, আর  বছর ছয়েকের ঐশানি সর্দার হাউহাউ করে কেঁদেই চলেছে। ওদিকে সুমন সর্দারের মা সাজোবালা সর্দার ২বছরের আর এক নাতনিকে কোলে নিয়ে পাথরের মতো বসে আছেন। তাঁর প্রশ্ন, কী করে মানুষ করবো এই চার ছোট ছোট মেয়েকে? কে এখন পড়াবে ওদের?
সুমনের বাবা দয়াল সর্দার বলেন, ‘ওর রোজগারে আমাদের আটটা পেট চলতো। এখন কী হবে?  সুমনের জেঠু পবন সর্দার জানিয়ে দেন, আমরা ক্ষতিপূরণ বাবদ ১০লক্ষ টাকা চাই না। তিনি দাবি করেন, পরিবারের  একজনের কাজের ব্যবস্থা করুক সরকার। সেই সাথে সঠিক তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। 
ন্যাজাটের পুরানো ফেরিঘাটে চায়ের দোকান ছিল দয়াল সর্দারের। সরকার পরিবর্তনের পর বেতনী নদীর পাড়ে পুরানো ফেরিঘাট সংস্কার করতে গিয়ে শাসকদলের রোষানলে পড়ে সিপিআই(এম)'র ঘনিষ্ঠ সমর্থক দয়াল সর্দার। চায়ের দোকান উঠে যায়। তারপর থেকে অসহায়। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন সুমন। অভাবের তাড়নায় হতে হয় পরিযায়ী শ্রমিক। বাবার অন্ধত্ব এবং কর্মহীন হয়ে পড়ায় গোটা পরিবারের ভার নিতে হয় সুমনকে। বানতলার লেদার কমপ্লেক্সে কেএমডিএ’র স্থায়ী কর্মী হিসাবে সেন্টারিংয়ের কাজে নিযুক্ত হন। কিন্তু তাহলে ম্যানহোলের মধ্যে তাঁকে নামতে হলো কেন, ম্যানহোলে কাজ করার কথা তো তার নয়— এই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সর্দার পরিবারে।
এদিন মৃত্যুর খবর শুনে পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী অধিকার মঞ্চের পক্ষ থেকে অমর মাহাতো পৌঁছান সুমন সর্দারের বাড়িতে, কথা বলেন পরিবারের সাথে। তিনি জানান, গোটা পরিবার সিপিআই(এম)'র বহুদিনের ঘনিষ্ঠ সমর্থক। এলাকায় বামপন্থীদের মিছিল মিটিংয়ে সুমন সর্দারের বাবা দয়াল সর্দার নিয়মিতই আসতেন। চোখে দেখতে না পাওয়ায় আর এখন আসতে পারেন না। ছেলের মৃত্যু সংবাদ আসতেই কান্নায় ভেঙে পরেন তিনি।

Comments :0

Login to leave a comment