Manik bhattacharya

মানিক-সিবিআই বোঝাপড়া, তীব্র ভর্ৎসনা বিচারপতিরই

রাজ্য

 সিবিআইয়ের সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের অপসারিত সভাপতি ও তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যের ‘সেটিং’র গুরুতর অভিযোগ তুললেন খোদ বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। 
সোমবার আদালতে দু’দফার শুনানিতেই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ধৃত মানিক ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের তদন্তের গতি নিয়ে তীব্র ভর্ৎসনা করে বলেন, ‘‘আমার মনে হচ্ছে, মানিক ভট্টাচার্যের সঙ্গে সিবিআইয়ের কোনও বোঝাপড়া হয়েছে। তাই আমি নির্দেশ দেওয়ার পরেও সিবিআই জেলে গিয়ে মানিক ভট্টাচার্যকে জেরা করছে না।’’
নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে এবার সরাসরি সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে অভিযুক্তের সঙ্গে যোগসাজশের নজিরবিহীন অভিযোগ তুলল খোদ আদালতই। বিচারপতির ভর্ৎসনার মুখে সিবিআই সুপ্রিম কোর্টে মানিক ভট্টাচার্যের ওপর রক্ষাকবচের প্রসঙ্গ তোলে। তখন বিচারপতি পালটা বলেন, ‘‘২০২২ সালে সুপ্রিম কোর্ট রক্ষাকবচ দিয়েছিল মানিক ভট্টাচার্যকে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তো তদন্ত করা যাবে না বা জেরা করা যাবে না এমন কিছু বলেনি। আমি নির্দেশ দেওয়ার পরেও কেন মানিক ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে না সিবিআই? আমার তো মনে হচ্ছে, সিবিআইয়ের সঙ্গে কোনও বোঝাপড়া হয়েছে ধৃত মানিক ভট্টাচার্যের। তাই সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে মানিক রক্ষাকবচ পেয়ে গিয়েছিলেন। সিবিআই হয়তো এটাই চেয়েছিল।’’
নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় বর্তমানে প্রেসিডেন্সি জেলে রয়েছেন মানিক ভট্টাচার্য ও তাঁর পুত্র। তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তে জেলে গিয়ে জেরা করার নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। পরে সুপ্রিম কোর্ট সেই নির্দেশে স্থগিতাদেশ দেয়। যদিও সুপ্রিম কোর্ট তদন্তে স্থগিতাদেশ দেয়নি তারপরেও সিবিআই কেন মানিকের বিরুদ্ধে উদাসীন, তাহলে কি যোগসাজশ রয়েছে, সেই প্রশ্নই বারেবারে তুলেছেন এদিন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। এরপরেই লোকসভা ভোটের প্রসঙ্গ টেনে বিচারপতি বলেন, ‘‘লোকসভা ভোট ঘোষণা হওয়ার পরে কি পদক্ষেপ করবেন? আপনারা মুখে বলেছেন আদালতের নজরদারিতে তদন্ত চলছে। কিন্তু আদতে আদালতকেই কাঁচকলা দেখাচ্ছেন।’’
‘‘শুধু প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতি, ওএমআর শিট কারচুপির মামলায় নয়, পোস্টিং দুর্নীতিরও মাথা মানিক ভট্টাচার্য। এই গোটা দুর্নীতি তাঁরই মস্তিস্কপ্রসূত’’, বলে মন্তব্য করেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। এরপর তিনি এদিনই দুপুরে দ্বিতীয়ার্ধে সিবিআই-কে মানিকের মামলায় রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দেন। দুপুর ২টোর মধ্যে তদন্তের রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।
একই সঙ্গে এদিনই আবার প্রাথমিকের দুর্নীতি মামলার সম্পূর্ণ কেস ডায়েরি সিবিআই-কে আদালতে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি। মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় তা জমা দিতে হবে। সিবিআইয়ের তরফে জানানো হয়, মঙ্গলবারের শুনানিতে তা জমা দেওয়া হবে।
তবে প্রথমার্ধের শুনানিতেই শেষ নয়। দুপুর ২টায় দ্বিতীয় দফার শুনানিতে আরো নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়। 
বিচারপতির নির্দেশে আদালতে এদিন দুপুরেই সেই রিপোর্ট জমা দেয় সিবিআই। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্রে জানা গেছে, আদালতে পেশ করা সেই রিপোর্টে প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতিতে আরো একাধিক বিধায়ক, মন্ত্রী, এমনকি কাউন্সিলরের নামও রয়েছে। মুখবন্ধ খামে সেই রিপোর্ট বিচারপতির কাছে জমা দেয় সিবিআই।
আর সেই রিপোর্ট দেখেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় মন্তব্য করেন, ‘‘এ তো দেখছি সব মহাপুরুষদের নাম, কবে জেরা করবেন? লোকসভা ভোট মিটে গেলে?’’ সিবিআই জানায়, এর মধ্যে কয়েকজনকে জেরা করা হয়েছে। বাকিদেরও হবে। তখন বিচারপতি বলেন, ‘‘আর কবে জেরা করবেন? প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে যেভাবে তদন্ত হচ্ছে তা মানুষ কি ভালোভাবে নিচ্ছে, এত দীর্ঘসূত্রিতা কেন?’’ 
সিবিআইয়ের তরফে আইনজীবী তখন এজলাসে বলেন, ‘‘অনেককেই জিজ্ঞসাবাদ করা হয়েছে। বাকিদেরও করা হবে। এজলাসে সব কিছু বলা যাবে না। কোর্টের তত্ত্বাবধানেই তদন্ত হচ্ছে।’’ পালটা বিচারপতি বলেন, ‘‘কোর্টের তত্ত্বাবধানে তদন্ত হচ্ছে, অথচ সেই আদালতকেই তো কাঁচকলা দেখাচ্ছেন আপনারা। এত বড় দুর্নীতি, এত বড় সব নাম অথচ তদন্তের হাল কী হচ্ছে!’’
দ্বিতীয়ার্ধের শুনানিতেও মানিক ভট্টাচার্যের প্রসঙ্গ তুলে সিবিআইয়ের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়ার কথা তুলে ধরে বিচারপতি সেই বোঝাপড়ার কথা বলে ভর্ৎসনা করেন। 
শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ কেলেঙ্কারির মামলায় কলকাতা হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন ধৃত প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের স্ত্রী শতরূপা ভট্টাচার্য। ফলে এখন সিবিআইয়ের এই মানিক ভট্টাচার্য তদন্তের গতি নিয়ে বিচারপতি প্রশ্ন তোলা স্বাভাবিকভাবেই তাৎপর্যপূর্ণ। মানিক ভট্টাচার্য গোটা দুর্নীতির অন্যতম মাথা, বারেবারেই বলছে আদালত। ইডি’র চার্জশিটেও এই তৃণমূল বিধায়কের বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ, টাকার বিনিময়ে পাশ করিয়ে দেওয়া, ওএমআর শিট কারচুপি, একাধিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, বিদেশে টাকা পাচার, স্ত্রী ও পুত্রের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা পাচার, পুত্রের নাম ভুয়ো সংস্থায় টাকা পাচার সহ একাধিক গুরুতর অভিযোগ। 
এদিকে, গত ৫ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে টেটের মামলার শুনানিতে সিবিআইয়ের তরফে আইনজীবী ডেপুটি সলিসিটর জেনারেল বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে ২০১৪ সালের টেট দুর্নীতি আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের মত সুবিশাল বড়। আগামী ৯/১১ অর্থাৎ ১১ সেপ্টেম্বরই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সমান এই বিশাল দুর্নীতির খতিয়ান আমরা প্রকাশ করব, আদালতেই সব প্রকাশ করব।’’ এরপরেই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘দুর্নীতি যদি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সমান হয়, তা হলে তাতে সেটা অবিলম্বে ভেঙে ফেলা দরকার।’’ যদিও ১১ তারিখে, এমনকি তারপরে ১২ তারিখেও সেই রিপোর্ট জমা দেয়নি সিবিআই। স্বাভাবিকভাবে তা নিয়েও জনমানসে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। 
অন্যদিকে, সিবিআইয়ের এদিনের জমা দেওয়া রিপোর্টে একাধিক বিধায়ক, মন্ত্রী ও কলকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলরের নাম সামনে আসায় ফের নতুন করে চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। সিবিআইয়ের তরফে যদিও সেই নাম এদিন প্রকাশ্যে বলা হয়নি।

Comments :0

Login to leave a comment